অগ্রহায়ণে নবান্নের রেশ কাটতে না কাটতে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে গাঢ় হতে শুরু করেছে শীত। পশ্চিমের অনেকের কাছে হয়তো শীতকে জবুথবু, শুষ্ক, রিক্ত আর ম্লান মনে হয়; কিন্তু আমাদের এই দেশে এ সময়ে প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়ে তোলে অপরূপ করে। বাংলাদেশের মতো শীতের এত বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য বোধ হয় আর কোথাও নেই। পঞ্জিকার পাতায় ডিসেম্বর এলেই তাই ধুলাময় শহরে ইটের খাঁচায় বন্দী মন কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে। হলুদ ফুলে ছেয়ে যাওয়া শর্ষেখেতে ছুটে বেড়াতে মন চায়। শীতে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবলে প্রথমেই মাথায় আসে গ্রামের কথা।
নিভৃত কোনো গ্রামের ঘরে ঘুম ভাঙবে টিনের চালায় পড়া টিপটিপ শিশিরের শব্দে। কুয়াশায় মোড়ানো হিম–সকালে সূর্য ওঠার নাম–নিশানা থাকবে না। গায়ে মোটা চাদর জাপটে শিশিরভেজা ঘাস মাড়িয়ে খেতের আইলে দাঁড়িয়ে সাদা বকের উড়ে যাওয়া দেখব। গাছিরা খেজুরগাছ থেকে রসভর্তি মাটির ভাঁড় নামিয়ে আনবেন। আবছা আলোয় ভেজা ভেজা মেঠো পথে দাঁড়িয়েই চুমুকে সাবাড় করে দেব সেই রস (যদিও হালে কাঁচা রস খেয়ে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কাঁচা রস পান থেকে বিরত থাকতে বলেছেন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা)।
বাংলাদেশের প্রায় সব কটি গ্রামের চিত্র কমবেশি একরকম হলেও শীতের এ সময়ে উত্তরাঞ্চলের সৌন্দর্য অন্য রকম। হিমালয়ের খুব কাছে বলেই হয়তো এখানে শীত একটু আগেভাগেই চলে আসে। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরের গ্রামগুলোতে এ সময়ে শুরু হয় হিম–উৎসব। সদ্য কাটা ধানের খেতে শিশিরভেজা খড়ের উন্মাতাল ঘ্রাণ ম–ম করে চারদিকে। বটতলায় বসা হাটগুলোতে ধোঁয়া ওঠা মালাই চায়ের কাপ নিয়ে চলবে ধুম আড্ডা। আড়মোড়া ভেঙে ধীরে ধীরে জেগে উঠবে প্রকৃতি, হাটবাজারে বাড়তে থাকবে লোকসমাগম। কিষান–কিষানিরা খেত থেকে তুলে আনবেন তাজা শাকসবজি।কুয়াশামাখা ভোরে উত্তরাঞ্চলের পুরাকীর্তির স্থানগুলোয় ঘুরতে গিয়ে মনে হয় যেন অতীতে ফিরে গেছি। ঘুরতে ঘুরতে খোঁজ মিলবে আশপাশের গ্রামে কোথাও মেলা বসেছে। সেই মেলায় এসেছে সার্কাস। দুপুরে পেট পুরে খেয়ে রওনা হব সার্কাস দেখতে। এ সময় কান্তজিউ মন্দিরের চত্বরেও মেলা বসে। বিকেলের মিষ্টি রোদে মন্দিরের কারুকাজ দেখে উল্লসিত হওয়ার পাশাপাশি এই মেলাগুলোয় উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করে শৈশবে ফিরে যেতে বেশ লাগে।
আমার আরেকটি প্রিয় শীতকালীন এস্কেপ রুট হচ্ছে শেরপুর, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী অঞ্চল। সেখানকার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য উপভোগ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো বর্ডার রোড দিয়ে হাইকিং। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশের এই অঞ্চলে কিছুদূর পরপর পাহাড়ি ছড়া বা নদী নেমে এসেছে। ওই নদীগুলোর স্বচ্ছ সাদা বালুর তীর ধরে হেঁটে বেড়ানো, সঙ্গে ছোট ছোট জনপদ—অন্য রকম এক ভালো লাগা।এই ঋতুতে শ্রীমঙ্গলও অসম্ভব ভালো লাগে। আসলে শ্রীমঙ্গল জায়গাটি সব ঋতুতেই আমার ভালো লাগে। খুব কাছে বলেই শুধু নয়, এই সবুজ টিলার দেশে সব সময় ঝিমধরা শান্তি বিরাজ করে। তাই মন ভালো থাকলেও শ্রীমঙ্গল, মন খারাপ থাকলেও শ্রীমঙ্গল।
আলোভাঙা ভোরে আবছায়ার মধ্য দিয়ে পিচের মসৃণ রাস্তা ধরে তিন চাকার ভ্যানভর্তি লেবু নিয়ে হেঁটে আসা ধূসর মানুষ, কুয়াশায় ঢাকা বিস্তীর্ণ চা–বাগান, গাছে ডেকে চলা নিঃসঙ্গ টিয়া আর নিস্তব্ধ নিসর্গের প্রেমে ঘায়েল হবেন না এমন মানুষ মেলা ভার।এই ঋতুতে আমরা খুব সচেতনভাবেই কক্সবাজার–সেন্ট মার্টিনের মতো জায়গাগুলো এড়িয়ে চলি (তার মানে এই না যে আপনিও এড়িয়ে চলবেন)। শহরের ভিড়ে অতিষ্ঠ হয়ে আবারও ভিড়ের মধে৵ গিয়ে পড়তে একেবারেই ভালো লাগে না। কিন্তু এ সময় সমুদ্র অপরূপ হয়ে ওঠে। উত্তাল ঢেউও তখন শান্ত হয়ে আসে। লোকালয় থেকে দূরে পটুয়াখালী, বরগুনা, সোনাদিয়া, মহেশখালী ও ভোলার নির্জন চরগুলোর ঝাউতলায় এ সময় কিছুদিন ক্যাম্প করে থাকতে খুবই ভালো লাগে। ব্যাকপ্যাকেই সব খাবারদাবার থাকবে, রান্নার সব জিনিস থাকবে। সাগরপাড়ের ঝাউগাছের ছায়ায় হ্যামক টাঙিয়ে সারা দিন শুয়ে বই পড়ব। একটু পরপর চা, মহিষ বাথানের দুধ আর দই, জেলেদের ধরা তাজা মাছ দিয়ে উদরপূর্তি হবে। একেই বলে শীতের পারফেক্ট গেট–অ্যাওয়ে।শীত চলে এসেছে, এই তো সময় ঘুরে বেড়ানোর।