‘ললনা ফ্যাশন’ নামে একটি ফেসবুক পেজে শাড়ির বিজ্ঞাপন দেখে পেজটির ইনবক্সে মেসেজ পাঠান ডা. মিতু বসাক। পরবর্তীতে তাদের কথা মতো শাড়ির অর্ডার নিশ্চিত করতে শর্ত অনুযায়ী বিকাশে ১০০ টাকা পাঠান তিনি। পরদিন দিন ২১ এপ্রিল একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কাকরাইল শাখায় ২০৫০ টাকা দিয়ে শাড়ির পার্সেলটি গ্রহণ করেন তিনি।
তবে বাসায় গিয়ে প্যাকেট খুলে তিনি দেখতে পান, তাকে নিম্নমানের শাড়ি দেয়া হয়েছে। অর্ডার করা শাড়ির সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। ওই ঘটনায় দীর্ঘ সময় চেষ্টা চালিয়েও টাকা ফেরত কিংবা অর্ডার করা শাড়ি না পেয়ে তিনি গত ১৯ মে হাতিরঝিল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।
ওই মামলায় তদন্ত করতে গিয়ে অনলাইনে পণ্য বেচা-কেনার নামে অভিনব প্রতারণার সংঘবদ্ধ চক্রের সন্ধান পায় সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি দল। রোববার (২৩ মে) রাতে রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফ;তার করা হয় চক্রটির মূলহোতা মো. ওয়াদুদ হোসেন, তার স্ত্রী খাদিজা আক্তার রুপা ও সহযোগী তানিম আল ইমরানকে।
মঙ্গলবার (২৫ মে) গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. জুনায়েদ আলম সরকার এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, তদন্তে তাদের প্রতারণা কাজে ব্যবহৃত ললনা ফ্যাশন, শাড়ি ঘর, স্টার শাড়ি, আজকের শপ, ইজি শপ, স্টাইল বারসহ মোট আটটি ফেসবুক পেজ পায় পুলিশ। আর সেসব পেজে গ্রেফতার ব্যক্তিদের এডিটর ও অ্যাডমিন হিসেবে কাজ করার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
যেভাবে কাস্টমারদের প্রলুব্ধ করা হতো
বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের শাড়ির ছবি সেই সব ব্র্যান্ডের ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করতেন তারা। তাছাড়া ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ থেকে শাড়ির ছবি সংগ্রহ করে নিজেদের পেজে স্বল্প মূল্যে বিক্রির বিজ্ঞাপন দিতো চক্রটি। কম দামে আকর্ষণীয় শাড়ির পাওয়ার প্রলোভনে কাস্টমাররা তাদের পেজে অর্ডার করে প্রতারণার শিকার হতেন।
ক্রেতারা যোগাযোগ করলে ব্লক কর দিতেন প্রতারকেরা অনলাইনের বিভিন্ন পেজ থেকে আসল পণ্যের ছবি ডাউনলোড করে পণ্যের মূল্য পরিবর্তন বা কম দেখিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রিত ফেসবুক পেজে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিতো চক্রটি। এরপর পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী ক্রেতাদের কাছ থেকে বিভিন্ন
ট্রানজেকশন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ডেলিভারি চার্জ হিসেবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা অগ্রিম নেয়া হতো। তারপর অর্ডার করা পণ্যের পরিবর্তে নিম্ন মানের শাড়ি প্যাকিং করে তা নিয়ে বিভিন্ন পার্সেল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে কাস্টমারের কাছে অফেরতযোগ্য শর্ত সাপেক্ষে পাঠানো হতো।
ভোক্তা বা ক্রেতা প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে কুরিয়ার সার্ভিস ও তাদের অনলাইন পেজে যোগাযোগ করলে প্রতারক চক্র তাদেরকে ব্লক করার মাধ্যমে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতো
কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধির মতো ক্রে;তাদের প্রলুব্ধ করতেন রুপা
পণ্য গ্রহণযোগ্য ও পেজও বিশ্বস্ত এমন তথ্য কাস্টমারের কাছে থেকে পৌঁছে দিতে বিশ্বাস অর্জনের কাজটি করতেন রুপা। তিনি মূলত কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। আগ্রহী ক্রেতাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে অনলাইন ট্রানজেকশন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ডেলিভারি চার্জের টাকা গ্রহণ করতেন তিনি।
অগ্রিম ও ক্যাশ অন ডেলিভারির শর্তে মানহীন পণ্য ডেলিভারি
প্রতারণা থেকে প্রাপ্ত টাকা বিভিন্ন বিকাশ অ্যাকাউন্ট ও একটি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে উত্তোলন করতেন ওয়াদুদ-রুপা দম্পতি। বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্ডার কনফার্ম করতে তারা পণ্য মূল্যের ১০ শতাংশ অগ্রিম গ্রহণ করতেন। আবার কখনো পুরোটাই তারা বিকাশে অগ্রিম নিয়ে নিতেন। কখনো ক্যাশ অন ডেলিভারি সিস্টেমে কুরিয়ারে তারা পার্সেল পাঠাতেন। ফলে কাস্টমাররা পণ্য হাতে পেয়ে প্রতারিত হলেও টাকা ফেরত কিংবা পণ্য ফেরত পাঠানোর সুযোগ পেতেন না।
প্রতারণার টাকা কাস্টমারদের কাছ থেকে সংগ্রহের জন্য নাঈম, আলিম ও পাভেল নামে আরও কয়েকজন বিকাশ অ্যাকাউন্ট ও তার পিন নম্বর ওয়াদুদ ও রুপাকে সরবরাহ করতেন। আর পেজে প্রতারণার কাজে সহযোগী হিসেবে
পেজগুলোর এডিটর ও অ্যাডমিন হয়ে পেজের বুস্টিং করাসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন তানিম। তিনি পেশায় একজন ছাত্র হলেও প্রতারণামূলক বুস্টিংয়ে বেশি টাকা মেলায় এই কাজ করে আসছিলেন।
এডিসি মো. জুনায়েদ আলম সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ওয়াদুদ হোসেন আগে কনস্ট্রাকশনের কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় এ প্রতারণা শুরু করেন। তার স্ত্রী খাদিজা আক্তার রুপা গৃহিনী হলেও ওয়াদুদের প্রতারণার কাজে সহযোগিতা করে আসছিলেন। আর সহযোগী তানিম পেশায় ছাত্র হলেও পাশাপাশি
বিভিন্ন পেজের বুস্টিংয়ের কাজ করেন। আর প্রতারণামূলক পেজে বুস্টিংয়ের জন্য রেট বেশি হারে নিয়ে থাকেন তিনি।
এ কর্মকর্তা আরও জানান, ওয়াদুদ ও রুপার নিয়ন্ত্রিত দুটি বিকাশ অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়, যার শেষ এক বছরে বিভিন্ন নম্বর থেকে লক্ষাধিক টাকার লেনদেনের তথ্য প্রমাণ মিলেছে। তাদের কাছ থেকে গত এক সপ্তাহের প্রতারণার কাজের ব্যবহৃত একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কন্ডিশনাল পেমেন্ট স্লিপ পাওয়া গেছে। ওই কুরিয়ারের অফেরতযোগ্য কন্ডিশনে ১৮ থেকে ২১ মে পর্যন্ত মোট ১৪টি পার্সেল পেমেন্ট স্লিপ জ;ব্দ করা হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা উত্তর ও সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান সরকার সাইবার স্পেসকে ব্যবহারে ব্যবসাকে প্রসারিত করেছে। বিশেষ করে এই করোনাকালে অনলাইন ব্যবসা এবং অনলাইনে কেনাকাটাকে উৎসাহিত করছে। তবে এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে অসাধু একটি প্রতারক চক্র অভিনব প্রতারণা করে আসছিল।
তিনি বলেন, গত তিন বছর ধরে এই চক্রটি এই অভিনব প্রতারণায় জড়িত। তারা অন্য পেজের ছবি ডাউনলোড করে তুলনামূলক কম দাম দেখিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রিত পেজে আপলোড করত। এরপর কম দাম দেখে বিপুল ক্রেতা তাদের পেজে কাঙ্খিত পণ্য অর্ডার করলে চক্রটি প্রতারণার আশ্রয় নিত।
ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ বলেন, অনলাইনে কেনাকাটা এখন অনেক সহজ ও প্রসারিত হলেও প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। তাই দেখেশুনে বুঝে কেনাকাটা করা উচিত। কেউ প্রতারিত হলে বা প্রতারক চক্রের সন্ধান পেলে সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগে অভিযোগ করার অনুরোধ জানান তিনি।