বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন তালিপাম প্রজাতির সর্বশেষ নমুনাটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ফুলার রোড সংলগ্ন উপ-উপাচার্যের বাসভবন চত্বরে। এই গাছের অনন্য বৈশিষ্ট্য প্রায় শত বছর পর মাত্র একবারই ফুল-ফল দিয়েই মারা যায় অর্থাৎ জীবনচক্র শেষ করে। মহাবিপন্ন এই গাছটির একটি রয়েছে টাঙ্গাইলের সার্কিট হাউজে। তবে শত বছর না হতেই মাত্র ১০ বছর বয়সে গাছটিতে ‘মরণফুল’ ফুটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১২ সালের ১৮ জুন তৎকালীন জেলা প্রশাসক এম বজলুল করিম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের বাসা থেকে এনে গাছটি রোপণ করেছিলেন। একই সময়ে টাঙ্গাইল করটিয়া সরকারি সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও কুমুদিনী সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে আরও দুটি এই গাছের চারা লাগানো হয়েছিল। তবে সেগুলোতে এখনো ফুল না আসলেও মাত্র ৯ বছর পর সার্কিট হাউজে রোপণ করা তালিপাম গাছেই ফুল ফুটেছে।
এত কম সময়ের মধ্যে এই গাছে ফুল ফোটার খবরে মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) সকালে একদল উদ্ভিদ গবেষক টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজে আসেন গাছটি পরিদর্শনে।
তালিপাম গাছের গবেষক ও সরকারি বাঙলা কলেজের রসায়নের সহকারী অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টের মহাপরিচালক অমি ড. মালা খান, হেলথ ইন হাসপাতালের গাইনি চিকিৎসক শারমিন সুলতানাসহ গবেষকরা গাছটি নিবিড়ভাবে পরিদর্শন করেন। তারা গাছটির ফুল, পাতা, শিকড়, ডালসহ বিভিন্ন উপকরণ গবেষণার জন্য সংগ্রহ করেন। এ সময় টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. আতাউল গনিসহ প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, ১৭৯৯ সালে সর্ব ভারতের পূর্বাঞ্চলে তালিপাম প্রজাতির সন্ধান পেয়েছিলেন ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী উইলিয়াম রক্সবার্গ। স্থানীয়ভাবে যা ‘বুনো তাল’ নামে পরিচিত ছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, বুনো তাল পূর্ববাংলার এনডেমিক উদ্ভিদ।
এনডেমিক উদ্ভিদ বলতে সেসব উদ্ভিদকে বোঝানো হয়, যা শুধু একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ অঞ্চলে জন্মে। তিনি এই প্রজাতিটি শনাক্ত করে বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেন।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমি জেলার শান্তি নিকেতন এলাকায় আরও একটি তালিপাম বৃক্ষ ছিল। বৃক্ষটিতে ফুল আসার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীরা তা কেটে ফেলেন। কথিত আছে, ১৯৭৯ সালে এই গাছে যখন ফুল আসে তখন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষেরা অশুভ মনে করে সেটি কেটে ফেলেন। অবশ্য ইতোপূর্বে ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর এম সালার খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃক্ষটিকে তালিপাম প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেন।
১৯৭৯ সালের পর পৃথিবীর অন্য কোথাও এ প্রজাতির সন্ধান না পাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদটি বিশ্বের একমাত্র বন্যতাল প্রজাতির নমুনা হিসেবে বিবেচিত হয়। যা ‘তালিপাম’ নামে পরিচিত। ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) তালিপামকে ‘বিশ্বের মহাবিপন্ন উদ্ভিদ’ হিসেবে ঘোষণা করে।
তালিপামের ফুল-ফল থেকে এ পর্যন্ত ৯টি সক্রিয় রাসায়নিক উপাদান সংশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে। যার কিছু কিছু উপাদান অণুজীব ধ্বংসকারী, বার্ধক্য ও ক্যান্সার প্রতিরোধক গুণাগুণ সম্পন্ন। এর মধ্যে বিটুলিনিক অ্যাসিড ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে বলে জানিয়েছেন উদ্ভিদ গবেষকরা।
তালিপাম গাছের গবেষক ও সরকারি বাঙলা কলেজের রসায়নের সহকারী অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম থেকে ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘রেড ডাটা বুক অব ভাসকুলার প্লান্টস অব বাংলাদেশ’ থেকে জানতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তালিপাম’ নামে একটি গাছ আছে। বৃক্ষটি ১০০ বছর পর মাত্র একবারই ফুল-ফল দিয়ে মারা যাবে। কাকতালীয়ভাবে ঠিক তখনই বৃক্ষটিতে মঞ্জুরী বের হয়। সময়টি ছিল ২০০৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বৃক্ষপ্রেমী মানুষের মধ্যে প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি হয়। পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে লেখালেখি হতে থাকে। এই সময় ট্র্যাডিশনাল ট্রিটমেন্ট মানে প্রচলিত চিকিৎসার একটি কথা আমার মনে পড়ে যায়। যে গাছ একবার ফুল-ফল দিয়ে মরে যায় সে গাছ ঔষধি। তখন মনে হয়, যেহেতু বৃক্ষটি ১০০ বছর পর একবার ফুল-ফল দিয়ে মরে যাবে, নিশ্চয় এর ফুল-ফল থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি উপাদান পাওয়া যাবে। তাই তালিপাম নিয়েই পিএইচডি কোর্সের গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নেই।”
‘আমার সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. আশরাফুল আলম ও কো-সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. আব্দুর রশীদকে জানালে তারা সানন্দে রাজি হন। কারণ ইতোমধ্যে গাছটি সম্পর্কে সুপারভাইজার ও কো-সুপারভাইজার দুজনই জেনেছেন। কো-সুপারভাইজার থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টাওয়ার ভবনের একটি ফ্ল্যাটে, গাছটি থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে। শুরু হয় তালিপামের ফুল, অপরিপক্ষ ও পরিণত হওয়া নিয়ে পিএইচডি কোর্সের গবেষণার কাজ।’
‘এ ভাবনা থেকেই প্রতি সপ্তাহে ওই গাছের কাছে গিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতাম। বিগত ২০১০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস। একদিন ভোরে গাছের নিচে গিয়ে দেখি চার-পাঁচটার মতো বীজ পড়েছে মাটিতে। সেগুলো বাসায় নিয়ে অঙ্কুরোদগমের জন্য বাসার বারান্দায় টবে দিলাম। পাশাপাশি গাছ থেকে ঝরে পড়া ফল সংগ্রহ করতে থাকলাম। এভাবে প্রায় এক হাজারের মতো বীজ সংগ্রহ করলাম। ৫০০ বীজ রেখে দিলাম গবেষণার জন্য। অঙ্কুরোদগমের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের মেডিসিনাল প্লান্ট গার্ডেনে পলিব্যাগে দিলাম তিনশোর মতো বীজ এবং বাকি দুইশো দিলাম আজিমপুর কোয়ার্টারের নিচে।’
‘টবে দেয়ার দুই-আড়াই মাসের মধ্যে বীজগুলো অঙ্কুরোদগম হলো। অঙ্কুরোদগমের পর চারাগুলো আট-দশ ইঞ্চি হয়ে গেলে সিদ্ধান্ত নেই এগুলো দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেব, যাতে বৃক্ষটি যথাযথ সংরক্ষিত হয় এবং শত বছর পর ২১১০ সালের দিকে যখন ফুল-ফল আসবে তখন ভবিষ্যৎ গবেষকরা যেন বৃক্ষটি নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করতে পারেন’, বলেন তালিপাম গাছের গবেষক অধ্যাপক আখতারুজ্জামান চৌধুরী।
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ২০১২ সালে তালিপামের গাছ রোপণ করা হয় জানিয়ে বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টের মহাপরিচালক অমি ড. মালা খান বলেন, ‘তালিপাম মহাবিপন্ন প্রজাতির একটি উদ্ভিদ। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষা অনুযায়ী, ১০০ বছর পরে এটাতে ফুল আসবে ফল হবে এবং তারপর গাছটি মরে যাবে। এটাই হলো তালিপামের চরিত্র সম্পর্কে এ যাবত পর্যন্ত মানুষের কাছে জানা তথ্য। অথচ অত্যন্ত আশ্চর্যের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি প্রায় ১০ থেকে ১১ বছরের মাঝামাঝি সময়ে তালিপাম গাছে ফুল ফুটেছে। ড. আখতারুজ্জামান এবং টাঙ্গাইলের সাবেক জেলা প্রশাসক প্রয়াত এম বজলুর করিম চৌধুরির নিজ হাতে বপন করা এই গাছটিতে ফুল এসেছে। আমরা আশা করব যে আগামী এক বছরের মধ্যে হয়তো এটা নিয়ম অনুযায়ী তার ফলও আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে সারা বাংলাদেশে ১০০টি তালিপাম গাছ লাগানো আছে। বাকি যে ৯৯টি গাছ আছে তা অবজারভেশনে রাখা প্রয়োজন। এখানে (টাঙ্গাইলে) এই একটা গাছের মধ্যে পরিবর্তন হলো। এখন যদি দেখা যায় একই সময়ে লাগানো আরও ৯৯টি গাছের মধ্যে এ ধরনের পরিবর্তন আসছে না, তাহলে এই পরিবর্তনটাই টেস্ট করা ছাড়া বাকি তথ্য দেয়া সম্ভব না। আমরা দেখতে পারি যে এক বছর পরে এটার ফল আসছে কিনা। যে সময়ে ফল আসার কথা ছিল সেটা আসছে কিনা, ফল আসার পরে গাছটা মরে যাচ্ছে কিনা সেটা দেখতে হবে।’
‘আগামী মাসখানেকের মধ্যে আমরা হয়তো জিনোম সিকোয়েন্সিয়ের ফলাফলটা জানাতে পারব এবং ভবিষ্যতে আমাদের একটা পরিকল্পনা থাকবে অন্যান্য গাছগুলোকে অবজারভেশন করে সেখানেও যদি নতুন কোনো তথ্য থেকে থাকে সেটা আমরা জাতির কাছে, উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের কাছে এবং সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছে আমরা সেই তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব’, বলেন অমি ড. মালা খান।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. আতাউল গনি বলেন, আমরা এ গাছটি যথেষ্ট দেখাশোনা করছি। শত বছর পর ফুল ফুটে গাছটি মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যেই ফুল ফুটে গেছে। আমাদের জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণাগার সায়েন্সল্যাবের বিজ্ঞানীরা এখানে এসেছেন। তাদের পরামর্শ মতো এই গাছটিকে আমরা পরিচর্যা করব।
তিনি আরও বলেন, ‘সার্কিট হাউজের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এ রকম বিপন্নপ্রায় একটি বৃক্ষ থাকলে আমাদের যারা ভিজিটর আছেন তারা দেখে আনন্দ পাবেন। সেই সঙ্গে গাছটি টাঙ্গাইল জেলার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে।’