স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হু’ম’কি

আইন-আদালত গণমাধ্যম দেশ জুড়ে বাংলাদেশ বিশেষ প্রতিবেদন

সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম গত সোমবার সচিবালয়ে গিয়ে যে চরম হেনস্তার শিকার হয়েছেন এবং গত কয়েক দিনে যে দুর্ভোগ ও ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তা আমাদের উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত না করে পারে না। আমরা এই হেনস্তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আমরা মনে করি, এই অঘটন যেমন জনমুখী

প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য খারাপ নজির হয়ে থাকবে, তেমনই স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য সৃষ্টি করবে বড় হু’মকি। এই অঘটনের জন্য দায়ী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে যদিও রোজিনার

বিরুদ্ধেই ওই মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে গিয়ে ‘রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরি’ করার দায় চাপানো হয়েছে, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও তথ্যাদি বিবেচনায় আমাদের কাছে তা সাজানো অভিযোগ বলেই মনে হয়।

সহযোগী সংবাদপত্র দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম কয়েক মাস ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বড় বড় দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর জনপরিসরে প্রকাশ করে দেওয়ায় ওই মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তা ও

কর্মচারীদের আক্রোশ অস্বাভাবিক নয়। এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তথ্য চুরির অভিযোগ আনলেও তাকে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় পরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করার মধ্য দিয়ে এই সন্দেহই ভিত্তি পায় যে, ওই সময়

অভিযোগকারীরা ‘প্রমাণ’ তৈরির অনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বিবেচিত সচিবালয়ে একজন সাংবাদিককে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় বেআইনিভাবে

আটকে রাখা আইনের শাসনেরও স্পষ্ট ব্যত্যয়। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করাই নিয়ম। তার বদলে নিজেরা আটকে রাখার অধিকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোথায় পেয়েছে?

রোজিনা ইসলাম, তার স্বজন, সহকর্মী ও আইনজীবীর ভাষ্য ছাড়াও ওই ঘটনার যে কয়েকটি খণ্ডিত ভিডিওচিত্র সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে হেনস্তার চিত্র স্পষ্ট। রোজিনা ইসলামকে

থানায় সোপর্দ করার পর তার জামিন বিলম্বিত হওয়ার বিষয়টিও আমাদের বিস্মিত করেছে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, প্রথম দিনই আদালত তাকে জামিন দেবেন এবং পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া নিজস্ব গতিতে চলবে; কিন্তু দ্বিতীয় দিনের শুনানি শেষেও জামিন না মেলা দুর্ভাগ্যজনক।

বস্তুত যে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস আইন’ অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা একটি প্রমাণিত ‘কালা কানুন’। উপমহাদেশের স্বাধীনতাকামী নাগরিকদের হয়রানি ও হেনস্তার জন্য প্রবর্তিত আইনটি জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে চলতে পারে না। বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ প্রথম থেকেই

নিবর্তনমূলক এই আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে এসেছে। রোজিনা হেনস্তা ঘটনার মধ্য দিয়ে আইনটির অপব্যবহারের সুযোগ আরেকবার প্রমাণ হলো।

আরেকবার এও প্রমাণ হলো যে, আমাদের আমলাতন্ত্র ঔপনিবেশিক প্রবণতা পরিত্যাগ করতে পারেনি। এটাও মনে রাখা জরুরি, রোজিনাকে হেনস্তা সামগ্রিক আমলাতন্ত্রের অবস্থান প্রতিফলিত করে না। বরং দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বৃত্তমনস্ক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অতি উৎসাহ ছাড়া কিছু নয়।

আমাদের প্রশ্ন, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দায় গোটা আমলাতন্ত্র নেবে কেন? এই ঘটনার পর সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতিতে যথার্থই বলেছে যে- ‘একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের হীন চেষ্টা সংবাদপত্রের অস্তিত্বকে হুমকির দিকে ঠেলে দেয় ও পেশাকে চ্যালেঞ্জের দিকে নিয়ে যায়’। আমরা দেখেছি, এরই মধ্যে রোজিনা হেনস্তার ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ করেছে।

বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নাগরিক ও মানবাধিকার সংগঠন ছাড়াও খোদ জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ বিষয়ে নাগরিক ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার ও প্রশাসন এসব প্রতিক্রিয়া আমলে নেবে এবং রোজিনা ইসলামকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দেবে। একই সঙ্গে তাকে হেনস্তার

সঙ্গে জড়িতদের সবার বিরুদ্ধে অতি অবশ্যই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। হেনস্তাকারীরা পার পেয়ে গেলে এ ধরনের অঘটন আরও ঘটতে থাকবে এবং স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হবে। সেটা কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না।