৩৩৩ ফোন করে সাহায্য চাওয়ায় ঋণ করে জরিমানা দিলেন অসহায় পরিবার

দেশ জুড়ে

৩৩৩ এ ফোন দিয়ে খাদ্য সহায়তা চাওয়াই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো সেই ‘কথিত ৪তলা বাড়ির মালিক’ ফরিদ উদ্দিনের (৫৭)। ৭ ভাই বোনের মাঝে পৈত্তিক মালিকানায় পাওয়া সেই বাড়িতে ফরিদ উদ্দিনের রয়েছে ২টি মাত্র ছোট টিনশেড ঘর।

অনেকটা ‘নুন আনতে পান্তা’ ফুরানোর মত অবস্থায় দিন কাটানো ৩৩৩এ ‘ ত্রাণ চাওয়া ’ সেই ফরিদ উদ্দিনকেই দিতে হলো ১০০ দরিদ্র মানুষের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী। নিজের প্রতিবন্ধী ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে আগামী দিনগুলো কী করে কাটাবেন তিনি? সেই চিন্তায় শুক্রবার রাতে আ;ত্মহ’ত্যা;র চেষ্টাও করেছেন তিনি।

তাই রা;তভর তাকে পাহা;রা দিয়ে থাকতে হয়েছি;ল পরিবা;রের সদস্যদের। কারণ, প্রশাস;নের নি;র্দেশনা মতে ১০০ দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা করতে গিয়ে নিজের ও ভাইয়ে;র স্ত্রী;দের স্বর্ণালংকার বন্ধক রাখতে হয়েছে তাকে।

ঋণের এই টাকা পরিশোধ করার পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ছেলে আর নিজের চিকিৎসা খরচ কী করে যোগাড় হবে সেই চিন্তাই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল বৃদ্ধ ফরিদ উদ্দিনকে।

আর তার জীবনে এই ঘোর অন্ধকার নামার নেপথ্যে ছিলেন ওই এলাকার স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার ও আওয়ামী লীগ নেতা আইয়ুব আলী। ৩৩৩ এ ফোন করে সাহায্য চাওয়ার পর উপজেলা প্রশাসন থেকে তদন্তে আসা ব্যক্তিদেরকে তিনিই প্রথম জানিয়েছিলেন, ফরিদ উদ্দিন ওই ৪তলা বাড়ির মালিক এবং একজন ব্যবসায়ী।

শনিবার সেই ত্রাণ বিতরণের সময়েও আইয়ুব আলী ক্ষো;ভ প্রকাশ করে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বলেছেন, ফরিদ উদ্দিন যথেষ্ট সচ্ছল। আর যদি ত্রা;ণের দরকার হয়ে থাকে তবে তাকে না জানিয়ে ৩৩৩এ ফোন দেয়াটা ছিল ‘ভুল ও অন্যায়’। এতে তার য;থেষ্ট ‘ডিস;ক্রেডিট’ হয়েছে।

অপর;দিকে ‘লঘু পা;প’ না ক;রেও ;গুরু ;দণ্ডে দণ্ডি;ত ফরি;দ উ;দ্দিনকে নি;য়ে এখন বেশ ‘অ;স্বস্তিকর’ পরিবেশে পতিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা প্রশাসন। কথিত ‘৪তলা বাড়ীর মালিক’ শেষ পর্যন্ত ২ কামড়ার

অসুস্থ ছাপোষা চাকরিজীবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পাশাপাশি তার বৃদ্ধ স্ত্রী আর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছেলেকে দেখে তারা ‘হকচকিয়ে’ গিয়েছেন।

খোদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরা সেই ত্রাণ দিতে গিয়ে ফরিদ উদ্দিনের পরিবারকে বলেছেন, বিষয়টি তার খুব ভালো ভাবেই দেখবেন এবং ফরিদ উদ্দিনের ব্যাপারে ভ্রান্ত তথ্য দেয়া স্থানীয় মেম্বারের ব্যাপারেও প্রয়োজনে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

শনিবার বিকালে সরেজমিনে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নাগবাড়ি শেষ মাথা এলাকার গিয়ে দেখা গেছে, পিতার রেখে যাওয়া ভবনের ৩য় তলার এক পাশের ছাদে টিনশেডের ২টি ছোট্ট কামড়ায় একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন ফরিদ উদ্দিন (৫৭)। একটি হোসিয়ারি দোকানে চাকরি করে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতনে কোনোমতে চলে তার সংসার চলতো।

মাস তিনেক আগে ব্রেইন স্ট্রোক করে বাম চোখটির দৃষ্টি শক্তি হারা’নোর পাশাপাশি কথাবা’র্তাও খুব একটা গুছিয়ে

বলতে পারেন না। কখনো কখনো দুপুরেই ভুলে যান সকালে কি বলেছেন। তাই সেই পুরনো দোকানেই মালিকপক্ষ মানবতার খাতিরে তাকে এখনও চাকরি করার সুযোগ দিয়েছে ৮ হাজার টাকা বেতনে।

লকডাউনের কারণে সংসার আর নিজের চিকিৎসা নিয়ে বেশ বেগ পোহাচ্ছিলেন এই বৃদ্ধ। কিন্তু ৩৩৩ নাম্বারে প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য অনেক খাদ্য পাওয়ার আশায় ফোন করাটাই যেন কাল হলো তার।

শনিবার বিকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ফরদি উদ্দিনের বাড়ির সামনের রাস্তায় শত মানুষের ভিড়। স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার আইয়ুব আলীর নেতৃত্বে তার লোকজন ত্রাণ নিতে আসা মানুষদের লাইনে দাঁড় করানোর কাজে ব্যস্ত।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আসার কথা আছে বলে সেখানে চেয়ার টেবিলও সাজিয়ে রেখেছেন আইয়ুব আলী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো ত্রাণ সহায়তা তিনিই দিচ্ছেন। কিন্তু ওই বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র।

সেই কথিত ৪ তলা বাড়ির মালিক ফরিদ উদ্দিন, তার স্ত্রী ও প্রতিবন্ধী এক কিশোরকে নিয়ে অসহায়ের মত এক কোণে কাঁদছিলেন। কথা বলতে গেলে ভয়ে কিছুই বলছিলেন না। এরপর ফরিদ উদ্দিনের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী মূল বিষয়টি বলার পর মুখ খুললেন তারা।

ফরিদ ও তার স্ত্রী হিরন বেগম জানালেন, প্রকৃতপক্ষে প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য সরকারের তরফ থেকে অনেক খাদ্য পাওয়ার আশাতেই ৩৩৩ এ ফোন দিয়েছিলেন ফরিদ উদ্দিন। ফোন করার ২ দিন পর সেখান থেকে তার ঠিকানা জানা

হয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন ইউএনও আরিফা জহুরাসহ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

ফরিদ উদ্দিন বলেন, ইউএনও আমাকে বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে আমি সত্যটাই বলেছি যে বাড়ির মালিক আমি। তিনি আমাকে বলেছেন আমি বৃদ্ধ মানুষ তাই জেল জ;রিমানা দিলাম না। কিন্তু যেহেতু আমি সচ্ছল হয়ে খাবার চেয়েছি তাই ১০০ দরিদ্রকে আমাকে ত্রাণ দিতে আদেশ করেন।

তিনি বলেন, আমি ভয়ে রাজি হই কিন্তু সে সময় আমার অবস্থাটা বলতে গিয়েও আমাকে স্থানীয় মেম্বার আইয়ুব আলী বলার সুযোগই দেননি। উল্টো ৩৩৩ এ ফোন না করে উনাকে কেন জানালাম না সেজন্য ধমকাতে থাকেন। এসব কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন ফরিদ উদ্দিন আর তার স্ত্রী। এসময় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল তার প্রতিবন্ধী ছেলেটি।

ফরিদের স্ত্রী জানান, ১০০ লোকের ত্রাণ যোগাড় করতে গিয়ে আমাদের স্বর্ণালংকার বন্ধক রাখতে হয়েছে, ধার করতে হয়েছে। মেম্বার আইয়ুব আলীও আমাদের সুদে ১০ হাজার টাকা ধার দিয়েছেন। গত ২ দিন আমরা ইউএনও আপার

কাছে যেতে চাইলেও মেম্বার আমাদের ভয় দেখিয়েছে যে ত্রাণ দেয়ার আদেশ না মানলে ৩ মাসের জেল হয়ে যাবে।

এদিকে সরেজমিনে ফরিদ উদ্দিনের সেই ছোট ২ কামড়ায় গিয়ে দেখা গেল ২টি ভাঙাচোরা খাট আর পুরানো কয়েকটি আসবাব ছাড়া কিছুই নেই।

এদিকে সেখানে থাকা স্থানীয় ইউপি মেম্বার আইয়ুব আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি। তবে বলেছেন, ফরিদ উদ্দিন একজন হোসিয়ারি ব্যবসায়ী, ৪ তলা বাড়ীর মালিক। সে কেন ৩৩৩ এ ফোন দিবে! আর খাবারের দরকার হলে আমাকে বলতো, আমি স্থানীয় মেম্বার। এটাতো আমার জন্য ‘ডিসক্রেডিট’।

তবে মাত্র ২ বাড়ি পাশে থেকেও ফরিদ উদ্দিনের প্রতিবন্ধী ছেলে নিয়ে কষ্টে আছেন এমনটি তিনি জানলেন না কী করে এমন প্রশ্ন করার পর নিজের বক্তব্য তাৎক্ষনিক ঘুরিয়ে দেন আইয়ুব আলী।

তিনি বলতে শুরু করেন, আমি ইউএনও ম্যাডামকে বলেছিলাম ১০ লোককে ত্রাণ দেয়ার অবস্থা ফরিদের নেই কিন্তু ততক্ষণে কিছু করার ছিল না।

অপরদিকে উপজেলা পরিষদের লোকজন তদন্তে আসার পর ৪ তলার বাড়ির মালিক কেন বলেছেন- এমন প্রশ্ন করলে আইয়ুব আলী উত্তর না দিয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের ‘বাড়ি থেকে সরবত বানিয়ে এনেছি খান’ বলে সটকে পরেন।

অপরদিকে বিষয়টি নিয়ে ইউএনও আরিফা জহুরার কার্যালয়ে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার ৩৩৩ কল সেন্টারের মাধ্যমে অসহায় ও দুস্থদের খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। কেউ ওই নম্বরে কল করে সংকটের কথা জানালে ইউএনও অফিসে জানানো হয়। পরে তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে যাচাই করে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়। ফরিদ উদ্দিনের বিষয়টি স্থানীয় মেম্বার আইয়ুব আলীই প্রথম তথ্য দিয়েছিলেন তিনি ৪তলা বাড়ির মালিক।

তিনি বলেন, পরবর্তীতে আমি যাচাই নিশ্চিত করতে নিজেই বৃহস্পতিবার সেখানে যাই। ফরিদ উদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে ওই বাড়ির মালিক তিনি এবং ৩৩৩ এ ফোন দিলে খাদ্য সহায়তা দেয়া কিনা দেখতেই

তিনি ফোন দিয়েছিলেন। আমরা সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করিনি কিন্তু যেহেতু তিনি সচ্ছল বলে জানতে পেরেছিলাম তাই উনাকে বলেছিলাম যেন তিনি এমন ১০০ দরিদ্রকে সহায়তা করেন। এজন্য তাকে ২দিন সময়ও দিয়েছি। কিন্তু এর মধ্যে কেউই কিন্তু আমাকে প্রকৃত সত্যটা জানায়নি বা ফরিদ উদ্দিনের পরিবার থেকেও কেউ জানাননি।

আরিফা জহুরা বলেন, যদি ঘটনা প্রকৃত পক্ষে এমনটি হয়ে থাকে তবে আমরা ভ্রান্ত তথ্য যে দিয়েছে তার ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিব এবং ফরিদ উদ্দিনকেও আমরা সহায়তা করবো।

নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ফরিদ উদ্দিন অসহায় বা অসমর্থ কিনা সেটি তদন্ত করা হবে। যদি সত্যিই অসহায় হয়ে থাকেন তাহলে তাকে সহযোগিতা করা হবে। ত্রাণ সহায়তা দিতে তার যে খরচ হয়েছে সেই অর্থও তাকে ফেরত দেওয়া হবে। দুইদিন সময় পাওয়ার পরও তারা কেন প্রশাসনকে তাদের অসহায়ত্বের কথা জানাননি সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।