স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে কৃষিপণ্যের কেনাবেচায় ভোক্তা, কৃষক, উদ্যোক্তা, কৃষি ব্যবসায়ীদের জন্য একটি অ্যাপ আনছে সরকার। কৃষি বিপণন অধিদফতরের এ অ্যাপের নাম ‘সদাই’। একই অ্যাপের মাধ্যমে পাঁচ ক্যাটাগরির অসংখ্য কৃষি উদ্যোক্তার অংশগ্রহণে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উপযুক্ত বিপণন ব্যবস্থা চালু হবে। একই সঙ্গে বিপণন চ্যানেলে মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা কমবে বলে মনে করছেন কৃষি বিপণন অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
অ্যাপের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ কৃষি পণ্য ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য এবং এলাকাভিত্তিক প্রসিদ্ধ কৃষিপণ্য এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কুরিয়ারের মাধ্যমে বিপণনের ব্যবস্থা করা হবে। যেমন- মধু, ঘি, সরিষার তেল, সূর্যমুখী তেল, কক্সবাজারের শুঁটকি, খুলনার চুঁইঝাল, বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কটকটি, হাতে ভাজা মুড়ি, চিড়া, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত আম, দিনাজপুরের লিচু, আচার ইত্যাদি।
‘সদাই’র ভোক্তাদের জন্য একটি, উদ্যোক্তাদের জন্য আরেকটা অ্যাপ থাকবে। একটি প্লাটফর্মেই পাওয়া যাবে সব কৃষিপণ্য। প্রাথমিকভাবে শুধু জেলা সদরে এ অ্যাপসের মাধ্যমে বিপণন কার্যক্রম চালু করা হবে। ক্রমান্বয়ে এর কার্যপরিধি উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হবে। কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে কৃষি বিপণন অধিদফতর, তাই উদ্যোক্তারা ইচ্ছামতো মূল্য নিতে পারবেন না।
সব অনলাইন উদ্যোক্তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম তদারকি করবে কৃষি বিপণন অধিদফতর। পণ্যের মান খারাপ হলে বা ভেজাল পণ্য সরবরাহ করলে অধিদফতর উদ্যোক্তার নিবন্ধন বাতিল করে ‘কৃষি বিপণন আইন-২০১৮’ ও ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’ অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ‘সদাই’র কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করতে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। চালুকরণের সময় চলতি মৌসুমের আম বিপণনকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে বিপণন অধিদফতর থেকে জানা গেছে।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ ইউসুফ জাগো নিউজকে বলেন, কৃষিপণ্য উৎপাদনে আমাদের কমতি না থাকলেও বিপণনে কিছু সমস্যা রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করে আমরা বিপণনের ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা আনতে চাচ্ছি। এজন্য
‘সদাই’ নামে দুটি অ্যাপ চালু করছি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অ্যাপটি ডেভেলপ করা হয়েছে। ‘সদাই’ অ্যাপের একটি ভোক্তা সাধারণের ব্যবহারের জন্য এবং অন্যটি উদ্যোক্তাদের জন্য। দুটো অ্যাপই গুগল প্লে স্টোর থেকে কৃষি উদ্যোক্তা ও ভোক্তা সাধারণ ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। আমরা মোটামুটি প্রস্তুত।
তিনি বলেন, ‘অ্যাপটি চালুও হয়েছে। জেলায় আমাদের উদ্যোক্তাদের নিয়ে শুরু করতে হবে। সেজন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এফএমজি (ফার্মার্স মার্কেটিং গ্রুপকে) গ্রুপ করে শুরু করার জন্য। আমরা ট্রায়ালে আছি। আমরা কৃষিমন্ত্রীর (মো. আব্দুর রাজ্জাক) সঙ্গে কথা বলে অ্যাপটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের জন্য একটি সময় নেব। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমরা উদ্বোধন করতে চাচ্ছি ।’
‘ই-কমার্সের মাধ্যমে অনেকে প্রতারণা করে, প্রায়ই এ ধরনের খবর গণমাধ্যমে আসছে। কিন্তু আমরা অ্যাপটি সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিংয়ে রাখব। কোনো ব্যত্যয় দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মানুষ আমাদের অ্যাপের ব্যাপারে আস্থা রাখতে পারবে’ বলেন বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক।
তিনি আরও বলেন, ‘সদাই হবে খুচরা ব্যবসায়ী, কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা, নারী উদ্যোক্তা ও ভোক্তা সাধারণের ব্যবহার উপযোগী একটি সমন্বিত প্লাটফর্ম। একটি প্লাটফর্মেই পাওয়া যাবে সব কৃষিপণ্য, সব অনলাইন কৃষি স্টোর।
অ্যাপের মাধ্যমে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বিপণন করা যাবে। মোবাইল অ্যাপভিত্তিক বিপণন কার্যক্রমের মাধ্যমে বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে ভোক্তা সাধারণের কৃষি বাজারে জনসমাগম কমানো যাবে। কোভিড পরিস্থিতির কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া যুব সম্প্রদায়ের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হবে।’
শুধু ‘সদাই’ অ্যাপে বিনামূল্যে নিবন্ধন করে একজন উদ্যোক্তা অনলাইন ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন জানিয়ে মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘যেখানে নিজ উদ্যোগে ওয়েব ও অ্যাপ তৈরি করতে তার (উদ্যোক্তা) বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হতো। সরকারি প্লাটফর্মে অনলাইন ব্যবসা করার কারণে ভোক্তা ও উদ্যোক্তার একে অন্যের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পাবে।’
বিপণন অধিদফতরের কর্মকর্তারা ‘সদাই’ অ্যাপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, ভোক্তা ও উদ্যোক্তারা অ্যাপটি রেজিস্ট্রেশন করবেন জেলাভিত্তিক। ভোক্তা যে জেলা থেকেই রেজিস্ট্রেশন করুক না কেন তিনি চাইলেই অ্যাপের মাধ্যমে অন্য জেলায় প্রবেশ করে অনলাইনে বাজার করতে পারবেন। ঢাকায় কর্মরত একজন ব্যক্তি চাইলে অন্য
জেলায় অবস্থানরত নিজ পরিবারের জন্য বাজার করে দিতে পারবেন এ অ্যাপের মাধ্যমে। প্রাথমিকভাবে শুধু জেলা সদরে এ অ্যাপের মাধ্যমে বিপণন কার্যক্রম চালু করা হবে। ক্রমান্বয়ে এর কার্যপরিধি উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হবে।
অ্যাপের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য এবং এলাকাভিত্তিক প্রসিদ্ধ কৃষিপণ্য এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কুরিয়ারের মাধ্যমে বিপণনের ব্যবস্থা করা হবে। যেমন- মধু, ঘি, সরিষার তেল, সূর্যমুখী তেল, কক্সবাজারের শুঁটকি, খুলনার চুঁইঝাল, বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কটকটি, হাতে ভাজা মুড়ি, চিড়া, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত আম, দিনাজপুরের লিচু, আচার ইত্যাদি।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (আইসিটি সেল) মো. বায়েজীদ বোস্তামী বলেন, ‘সদাই’ অ্যাপসে লগইন করার সাথে সাথে একজন ভোক্তা ডিফল্ট হিসেবে বিশেষ বিশেষ কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাতকৃত কৃষিপণ্য দেখতে পাবে। সেখান থেকে সারাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে সেই কৃষিপণ্য কিনতে পারবেন। ভোক্তারা যদি
নিজ জেলা থেকে কৃষিপণ্য নিজ জেলার ভেতরেই কিনতে চান সেই অপশনও পাশাপাশি থাকবে। অর্থাৎ এ অ্যাপসটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো কৃষি উদ্যোক্তা ও ভোক্তাদের নিজ জেলার মধ্যেও বিপণন করতে পারবেন আবার পুরো দেশের মধ্যেও বিপণন করতে পারবেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। পরবর্তী সময়ে কৃষি বিপণন অধিদফতরের বাস্তবায়নাধীন অনলাইনভিত্তিক কৃষি বিপণন ব্যবস্থা উন্নয়ন শীর্ষক কর্মসূচির মাধ্যমে এ অ্যাপের ওয়েব ভার্সন চালু করা হবে। এ অ্যাপের মাধ্যমে দেশব্যাপী টিসিবির পণ্য বিক্রি করা যাবে বলেও জানান সহকারী পরিচালক।
তিনি বলেন, ‘ভোক্তা ও উদ্যোক্তার রেটিং সিস্টেম চালু থাকবে। ফলে ভোক্তা ও উদ্যোক্তারা একে অপরকে রেটিং প্রদান করতে পারবেন। ফলে কৃষি উদ্যোক্তাদের পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে সহজেই ধারণা পাওয়া যাবে। পণ্যের মান খারাপ হলে স্থানীয় জেলা কৃষি বিপণন অধিদফতর ওই উদ্যোক্তার রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে কৃষি বিপণন আইন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।’
কৃষি উদ্যোক্তারা ক্যাশ অন ডেলিভারি, বিকাশ/নগদ/রকেটের মাধ্যমে তাদের পণ্য বিক্রয় করতে পারবেন। পরবর্তী সময়ে একটি সমন্বিত পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে নগদ, বিকাশ ও রকেট এবং ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থা থাকবে বলেও জানান বায়েজীদ বোস্তামী।
কৃষি বিপণন অধিদফতর অনলাইন উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম মনিটর ছাড়াও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ দেবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পণ্যের গ্রেডিং, সর্টিং, প্যাকেজিং, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। অনলাইন স্টোরগুলোর পণ্যের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ এবং পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত ও ক্ষেত্রবিশেষে পরিবহন সুবিধা দেবে অধিদফতর।’
পণ্যের ডেলিভারি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাজার থেকে এক বা একাধিক ডেলিভারি ম্যান নিয়োগ করা যাবে। যাদের ব্যয় নির্বাহ করা হবে ডেলিভারি চার্জ থেকে। যে সব জেলায় কৃষি বিপণন অধিদফতরের নিজস্ব পরিবহন ভ্যান রয়েছে সেখানে ডেলিভারির ক্ষেত্রে এ পরিবহন ভ্যান কৃষি উদ্যোক্তাদের ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হবে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
উদ্যোক্তার ধরন ক্যাটাগরি-১ (একক ও গ্রুপ ভিত্তিক) কৃষি বিপণন অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কৃষি উদ্যোক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন একজন ব্যক্তিকে নির্বাচন করা হবে, যিনি ভোক্তার অর্ডারকৃত পণ্য নিজ উদ্যোগে কিনে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে
পারবেন। এমন উদ্যোক্তা এ অ্যাপের মাধ্যমে যেকোনো ধরনের কৃষিপণ্য বিক্রয় করতে পারবেন। একক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব না হলে একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গ্রুপ গঠন করে এ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যেতে পারে। প্রতিটি উদ্যোক্তার জন্য একটি অনলাইন স্টোরের নাম নির্ধারণ করা হবে।
ক্যাটাগরি-২ (এফএমজি) ফার্মার্স মার্কেটিং গ্রুপকে (এফএমজি) এক একটি প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করে সেই গ্রুপের একজন তরুণ ও শিক্ষিত সদস্যকে উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচন করা হবে। এক্ষেত্রে সদাই অ্যাপসের জন্য ১০ সদস্য বিশিষ্ট এক বা একাধিক গ্রুপ গঠন করা হবে। প্রতিটি গ্রুপের জন্য একটা অনলাইন স্টোরের নাম নির্ধারণ করা হবে।
ক্যাটাগরি-৩ (কৃষি পণ্যের গ্রুপ ভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান) বর্তমানে অফলাইনে ব্যবসা করছেন এবং তার প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি নিজ উদ্যোগে ভোক্তার কাছে কৃষিপণ্য পৌঁছে দিতে পারবেন এমন প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে অনলাইন কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচন করা হবে।
এক্ষেত্রে এক একটি প্রতিষ্ঠান এক বা একাধিক কৃষিপণ্যের গ্রুপের পণ্য বিক্রয় করতে পারবে। প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান কোনো নাম থাকলে সেই নাম অনলাইন স্টোরের জন্য ব্যবহার করা হবে। নাম না থাকলে নতুন নাম নির্ধারণ করা হবে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি অনলাইনে ‘সদাই’অ্যাপসের মাধ্যমে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবেন।
ক্যাটাগরি-৪ (খামারি উদ্যোক্তা) নিজস্ব মুরগি, ডিম কিংবা মাছসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের খামার আছে এমন ব্যক্তি যিনি সরাসরি ভোক্তার কাছে তার উৎপাদিত কৃষিপণ্য পৌঁছে দিতে পারবেন, তাকে সদাই অ্যাপসের অনলাইন কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচন করা হবে। অনলাইন স্টোরের নাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে তার খামারের নাম ব্যবহার করা হবে।
এ ক্যাটাগরির উদ্যোক্তারা কেবল নিজ জেলায় বিপণন করতে পারবেন। এই ক্যাটাগরির উদ্যোক্তারা নিজ জেলার বাইরে বিপণন করতে চাইলে তাকে ক্যাটাগরি-৫ এ নিবন্ধন করতে হবে।
ক্যাটাগরি-৫ (প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান) নিজ নিজ এলাকার প্রতিষ্ঠান, যারা এলাকার কৃষিপণ্য বিক্রয়ে প্রসিদ্ধ- এমন প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে অনলাইন কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচন করা যাবে। এসব পণ্য দেশব্যাপী কুরিয়ারের মাধ্যমে এবং নিজ জেলার মধ্যে বিপণনের ব্যবস্থা করা হবে।