জেনেভায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে সম্মেলন শেষ হয়েছে। স্থানীয় সময় বুধবার নির্ধারিত সময়ের কিছু আগেই তিন ঘণ্টার মধ্যে দুই নেতার আলোচনা শেষ হয়। কিছু বিষয়ে একমত পোষণ করলেও দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জেনেভার বৈঠকের আগেই এর ফলাফল নিয়ে প্রত্যাশা ছিল কম। কূটনীতিকদের পুনর্বহাল করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপের বিষয়ে সম্মত হওয়ার প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি ছিল পুতিনের পক্ষ থেকে। তবে বুধবার দুই নেতার প্রথম মুখোমুখি বৈঠকে হৃদয় বদলাতে বাধ্য হওয়ার মতো কোনো ইঙ্গিত তিনি দেননি। রাশিয়ান নেতাকে জোর করে তাঁর দেশ বা দেশের বাইরের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা থেকে বিরত রাখতে কোনো বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ কাজে লাগবে বলে মনে হয় না।
বাইডেনের সঙ্গে তাঁর কোনো ধরনের শত্রুতা নেই, এমন কথা সংবাদ সম্মেলনে বললেও রাশিয়ার সমালোচনার জবাবে পুতিন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী তাঁর মনোভাব ধরেই রেখেছেন। সিএনএ যখন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থাগুলোতে সাইবার আক্রমণ নিয়ে প্রশ্ন করেছে, তখন পুতিন রাশিয়াতে সাইবার আক্রমণের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টিতে আমরা একমত হয়েছি যে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করব। আমি বিশ্বাস করি, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উভয় পক্ষকে কিছু নির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতা গ্রহণ করতে হবে।’
রাশিয়ার ঘরোয়া রাজনীতি সম্পর্কে কথা বললে পুতিন বারবার যুক্তরাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং নৈতিক অবস্থানের সমালোচনা করেছেন। তিনি ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গা ও জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি সামনে এনেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমেরিকার অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জন্য আপনাদের মুখ খোলার সময় নেই এবং গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটানো হয়েছে।’
ঘরোয়া রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, বিশেষ করে অ্যালেক্সি নাভালনি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি আসলে নিজে গ্রেপ্তার হতে চেয়েছিলেন। ওই ব্যক্তি জানতেন, তিনি রাশিয়ার আইন লঙ্ঘন করেছেন। তিনি দুবার দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তিনি জেনেবুঝে দুবার নিয়ম ভেঙেছেন। তিনি যা করতে চেয়েছিলেন, তা-ই করেছেন। তাই তাঁর সঙ্গে আমরা কী ধরনের আলোচনা করব?’
ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার অবৈধ দখল প্রসঙ্গে পুতিন দাবি করেছেন, তাঁর দেশের সেনা কার্যক্রম সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক আইন মেনেই পরিচালিত হয়। তিনি বরং যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ান সীমান্তে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আগ্রাসী হওয়ার জন্য অভিযোগ তোলেন।
ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আলোচনার কিছু নেই।
রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের নিয়মিত পর্যবেক্ষকেরা তাঁর এই স্তরের আত্মবিশ্বাস এবং গুরুত্ব না দেওয়ার বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত। পুতিন রাশিয়ায় নিজের ক্ষমতা এতটাই বেশি সুরক্ষিত করে রেখেছেন যে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠকে বুক ফুলিয়ে যেতে পারেন।
বাইডেন–পুতিন যা পেলেন
সম্মেলন শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, দুজনের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে, এটা ঠিক। তবে তা প্রতিশোধমূলক নয়। তিনি আরও বলেন, আশার কথা, রাশিয়া নতুন কোনো স্নায়ুযুদ্ধ চায় না। আর রাশিয়ার সাইবার হামলা নিয়েও কথা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আরও আলোচনা হবে।
আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, বাইডেন একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি জানান, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আশা রয়েছে। তিনি বলেন, এবারের বৈঠকের জন্য অনুরোধ করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে এটা নিশ্চিত করে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমকক্ষ নেতা হিসেবেই বৈঠকে যোগ দেন পুতিন। মস্কোর ক্রাইসিস গ্রুপের রাশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক ওলেগ ইগনাতোভ বলেন, ‘এটাই ক্রেমলিন চেয়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমকক্ষ হয়ে এমনভাবে বৈঠকে যোগ দিতে, যাতে বৈঠকের শর্ত হিসেবে অন্য পক্ষ কোনো অবস্থান বদল করতে বলতে না পারে।’
ওলেগ আরও বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে সংলাপটি স্থগিত হলে বা মস্কোর জন্য অসুবিধাজনক হলে পুতিন বাইডেনকে আরও পরীক্ষা নিতে থাকবেন। সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। এটি তাঁদের অবনতির একটা বিরতি।
ক্যাথাম হাউসের রাশিয়া অ্যান্ড ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের সিনিয়র কনসাল্টিং ফেলো কেইর গিলস যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে রাশিয়ায় পুতিনের সফলতার বড় সাফল্যের বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, রাশিয়ান মিডিয়া ও বিদেশি সাংবাদিকেরা যেভাবে সহজ প্রশ্ন করেছেন আর পুতিন তাঁর দৃঢ় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, এতে পুতিনকে দেশে আরও জয়ী হিসেবে দেখানো হবে।
পুতিনের সমর্থকদের চোখে, বাইডেনের সঙ্গে এ বৈঠক পুতিনকে তাঁর কার্যক্রমে আরও বৈধতা দেবে। তাঁরা বলবেন, পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোতে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন। তিনি এসব সামলেছেন নিজেকে বাঁচিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ত্রুটিগুলোকে সামনে তুলে ধরে।
তবে জেনেভায় পুতিন ও বাইডেনের এবারের সম্মেলন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঠেকানোর একটি বড় সুযোগ হয়ে এসেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাশিয়ার ওপর অতিরিক্ত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রাখতে বা বিরোধীদের গ্রেপ্তারের জন্য পুতিনকে তিরস্কার করতে কুণ্ঠাবোধ হবে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, পুতিন জেনেভায় গিয়ে যা চেয়েছিলেন, তা-ই পেয়েছেন। তিনি সুইজারল্যান্ড ছেড়েছেন কূটনীতিক জয় নিয়েই।