বিশ বছর পর টাঙ্গাইলে নিজ ঠিকানায় শাহনাজ

ঢাকা দেশ জুড়ে

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে ৫ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া শাহনাজ বিশ বছর পর স্বামী-সন্তান নিয়ে ফিরেছেন আপন ঠিকানায়। তবে তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ২০টি বছর।

বঞ্চিত হয়েছেন মা-বাবা আর আত্মীয়স্বজনের ভালোবাসা থেকে। প্রকৃত মা-বাবার নামটিও ব্যবহার করার সৌভাগ্য হয়নি জাতীয় পরিচয়পত্রে। শূন্যতা আর হতাশায় কেটেছে বিশটি বছর।

উপজেলার জিগাতলা গ্রামের আবু সাইদের মেয়ে শাহনাজ, জন্মের আড়াই বছরের মাথায় বিচ্ছেদ ঘটে মা-বাবার। বাকি আড়াই বছর কাটে তার দাদি-চাচির কাছে। বঞ্চিত হয় মায়ের আদর আর বাবার ভালোবাসা থেকে। ৫ বছর বয়সে চাচা নুরুজ্জামানের মাধ্যমে স্থান হয় টাঙ্গাইল শহরের ছবি নামে এক নারীর বাসায়। পরবর্তীতে ওই পরিবারটি শাহনাজকে নিয়ে ঢাকায় চলে যায়।

দুই বছর তাদের সাথে থাকার পর বাসার মালিকের মেয়েদের দুর্ব্যবহারের কারণে ৭ বছর বয়সে সেখান থেকে চলে যান তিনি।

পরবর্তীতে ঠাঁই হয় মাসুক আহমেদ নামে এক ব্যক্তির বাসায়। সেখানেই অতিবাহিত করেন তার বাকি জীবন। দুই বছর আগে ওই পরিবারই তাকে বিয়ে দেন নওগাঁর আত্রাইয়ের এক ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সঙ্গে।

কিছুদিন আগে রেডিও উপস্থাপক আরজে কিবরিয়ার ‘আপন ঠিকানা’ নামের একটি অনুষ্ঠানে শাহনাজকে নিয়ে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে। গত বছর তার চাচাতো ভাই রায়হান তার ফেসবুক আইডি থেকে শাহনাজের সন্ধান চেয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন। রায়হানের স্ট্যাটাসটি চোখে পড়ে এসকে আবদুল্লাহর।

শাহনাজের ভিডিওটি রায়হানের ফেসবুক মেসেঞ্জারে শেয়ার করেন। রায়হান ওই ভিডিওটি তার বাড়ির সবাইকে দেখান এবং ভিডিওটি তাদের হারিয়ে যাওয়া শাহনাজের সঙ্গে মিল খুঁজে পায়। পরে পরিবারের বর্ণনায় শাহনাজের মাথার চুল, কানে সমস্যা এবং শাহনাজের অন্যান্য বর্ণনা শুনে পরিবারের সবাই নিশ্চিত হন এই মেয়েটিই হারিয়ে যাওয়া তাদের শাহনাজ।

পরে ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ফিরে পান তাদের হারিয়ে যাওয়া মেয়েটিকে। গত ২০ জুন শাহনাজ তার স্বামী-সন্তানকে নিয়ে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার জিগাতলা গ্রামে পৈতৃক নিবাসে ফিরে আসেন। হারিয়ে যাওয়া শাহনাজকে পেয়ে তার আত্মীয়স্বজনসহ তাকে এক নজর দেখতে আশপাশের এলাকার শত শত মানুষ ভিড় করছেন।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালে পাঁচ বছর বয়সে হারিয়ে যান শাহনাজ। অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোথাও তাকে পায়নি তার পরিবার। শাহনাজ নিজের নাম ছাড়া বাবা-মা ও গ্রামের নাম কিছুই মনে করতে পারেনি। শাহনাজকে অন্যের বাসায় কাজে দেওয়ার পর তার চাচা মাঝে-মধ্যে যাতায়াত করতেন। তার চাচা রায়হান জানান, ৫ বছর বয়সে হারিয়ে যায় শাহনাজ। আমার বাবাসহ পুরো পরিবার অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পায়নি। আমি গত বছর আমার ফেসবুক আইডি থেকে শাহনাজের বর্ণনা দিয়ে তার সন্ধান চেয়ে একটি স্ট্যাটাস দেই। আমার স্ট্যাটাস দেখে এলাকার এক বড়ভাই এসকে আবদুল্লাহ (জুয়েল) বিদেশ থেকে একটি ভিডিও আমার ইনবক্সে দেন। ভিডিওটি দেখে আমরা নিশ্চিত হই যে, ওই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটিই আমাদের বোন শাহনাজ।

 

তিনি বলেন, আরজে কিবরিয়া ভাইসহ তার পুরো টিম ও এসকে আব্দুল্লাহ ভাইকে অনেক ধন্যবাদ। কারণ তাদের কারণে আমরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া বোনকে ফিরে পেয়েছি।

শাহনাজ বলেন, মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদের পর একটি পরিবারের কাছে আমাকে দেওয়া হয়। সেখান থেকে আমি হারিয়ে যাই। এরপর ঢাকার খিলগাঁওয়ে বাসাবোর কদমতলা এলাকার মাসুক আহমেদ আমাকে পেয়ে তার বাসায় নিয়ে যান। সেখানেই বড় হই এবং বিয়ে করি। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিতে আমার খুব খারাপ লাগত। তবে আমার শশুরবাড়ির মানুষগুলো খুব ভালো। সব কিছু জেনেই আমার স্বামী আমাকে বিয়ে করেছেন।

 

তিনি আরও বলেন, চাচার চেহারার বিবরণ ও কিছু আবছা আবছা স্মৃতি ছাড়া ছোটবেলার কোনো কিছুই মনে ছিল না। তবে চাচাকে প্রথম দেখাতেই চিনতে পারি। যদিও বাবা ও আত্মীয়স্বজনদের চিনতে কষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমার পরিবারকে ফিরে পেয়ে সেই কষ্ট দূর হয়েছে। এতে আমার স্বামীও খুব খুশি হয়েছেন। শাহনাজ ভালো থাকবে তার আপন ঠিকানায়- এটাই প্রত্যাশা সবার।