পায়ে হেঁটে হ’জ করা মানুষ

পায়ে হেঁটে হ’জ করা মহি উদ্দীনের বয়স এখন ১১৫

ধর্ম

দিনাজপুর রামসাগর জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করে রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে গিয়ে বামে ঘুরে কিছুদুর যেতেই চোখে পড়বে রামসাগরের পাষাণ বাঁ’ধা ঘাট আর পশ্চিম দিকে দেখা যাবে একটি ম’সজিদ। সেখানেই অ’তিশয় একজন বৃদ্ধকে চোখে পড়ত। তিনি রামসাগরে আসা পর্যট’কদের আহ্বান করতেন রামসাগর দিঘীপাড়া হাফেজিয়া ক্বারিয়ানা মাদরাসা ও এতিমখানায় দান করার জন্য।

 

সেই মানুষটি এখন আর সেখানে চোখে পড়বে না। বয়সের ভা’রে তিনি নুয়ে পড়েছেন। শরীরে নানা রোগ বাসা বেধেছে। এই মানুষটি বাংলাদেশ থেকে পাঁয়ে হেঁটে সৌদি আরব গিয়ে পবিত্র হ’জ পালন করেছিলেন।

তিনি হচ্ছেন দিনাজপুর সদর উপজে’লার রামসাগর দিঘীপাড়া গ্রামের মৃ’ত ইজার উদ্দীন ও মসিরন নেছার ছে’লে জাতীয় উদ্যানের বায়তুল আকসা জামে ম’সজিদের সাবেক ই’মাম হাজি মহি উদ্দীন।

পায়ে হেঁটে হ’জ করতে যেতে-আসতে তার সময় লেগেছিল ১৮ মাস। এ ১৮ মাসে তিনি পাড়ি দিয়েছেন কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ। এ সময় তিনি সফর করেছেন ৩০টি দেশ। যে দেশগুলো তিনি সফর করেছেন সে দেশগুলোর নাম এখনো মুখস্ত বলতে পারেন। ১৯০৬ সালের ১০ আগস্ট জন্ম নেয়া এই অদম্য মানুষটি বয়স এখন ১১৫ বছর।

 

হাজি মহি উদ্দীন দীর্ঘদিন রামসাগরে অবস্থিত বায়তুল আকসা ম’সজিদের ই’মাম ছিলেন। তিনি এখনো চোখে দেখলেও কানে শুনতে পান না। তিনি কানে শোনার জন্য একটি হেয়ারিং এইডমেশিন (কানে শোনার মেশিন) সহায়তা চেয়েছেন।

পরিবার ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাজি মহি উদ্দীন ১৯৬৮ সালে হ’জ করার উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে দিনাজপুর থেকে রওনা দেন। দিনাজপুর থেকে রংপুর হয়ে প্রথমে ঢাকার কাকরাইল ম’সজিদে যান। সেখানে গিয়ে পায়ে হেঁটে হ’জ পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তৎকালীন কাকরাইল ম’সজিদের ই’মাম মা’ওলানা আলী আকবর পায়ে হেঁটে যেতে ইচ্ছুক অন্য ১১ জনের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন। শুরু হয় ১২ জনের হ’জযাত্রা।

 

 

চট্টগ্রাম হয়ে ভা’রত যান। তারপর পা’কিস্তানের করাচি মক্কি ম’সজিদে গিয়ে অবস্থান করে সৌদি আরবের ভিসার জন্য আবেদন করেন। আটদিন পর সৌদি ভিসা পান। পাসপোর্ট ও ভিসা করতে খরচ হয় এক হ’জার ২০০ টাকা। ভিসা পেয়ে পা’কিস্তানের নোকঠি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ই’রানের তেহরান হয়ে ই’রাকের বাগদাদ ও কারবালা দিয়ে মিসর পাড়ি দিয়ে সৌদি আরব পৌঁছান।

 

পথে ফেরাউনের লা’শ দেখার ইচ্ছাও পূরণ হয় তাদের। সৌদি আরবে গিয়ে হ’জ পালন শেষে পায়ে হেঁটেই ফিরে আসেন নিজ পরিবারের কাছে। এ সময় তিনি ৩০টি দেশ পাড়ি দেন।

২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টম্বর এমন ক’ষ্ট করে হ’জ পালন প্রসঙ্গে নিজের অনুভূতি জানতে চাইলে হাজি মহি উদ্দীন জাগো নিউজকে বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থান থেকে ঘুরে আসার অনুভূতি বলে প্রকাশ করা যাবে না। তবে নিজেকে ধন্য মনে করি।
কেমন ক’ষ্ট হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো ক’ষ্ট করেছি বলে মনে হয় না। তবে ক’ষ্ট করেছেন আমা’র সহধ’র্মিণী আবেদা বেগম। অভাব-অনটনের মধ্যে আমা’র ইচ্ছার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আমাকে উৎসাহিত করেছেন। স্ত্রী’কে নিয়ে তিনি বেশ ভালো আছেন বলে মন্তব্য করেন। তার চার মে’য়ে ও দুই ছে’লে। তাদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে।

 

হাজি মহি উদ্দীন বয়সের কারণে ম’সজিদের ই’মামতি ছেড়ে দিয়েছেন। ছে’লেমে’য়েদের সহযোগিতায় চলে যায় তার সংসার। তবে অভাব-অনটনের কারণে করাতে পারেননি কানের চিকিৎসা। এখনো চোখে দেখলেও কানে শুনতে পান না। কানে শোনার জন্য তার একটি মেশিন প্রয়োজন। কিন্তু অর্থাভাবে মেশিনটি কিনতে পারেছেন না।

 

তিনি জানান, সে সময় পাসপোর্ট ও ভিসা করতে খরচ হয় এক হ’জার ২০০ টাকা। আর এক হাজার ৮০০ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে রওনা দেন। কিন্তু পথে ১২ জন হাজির দল দেখে মানুষ খাওয়া ও রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন। কেউ টাকা নেননি। ফিরে আসার সময়ও একই অবস্থা হয়। এ কারণে কোনো টাকা খরচ হয়নি। পুরো টাকাই তার ফেরত এসেছিল।

 

সোমবার (১৬ আগস্ট) বিকেলে কথা হয় হাজি মহি উদ্দীনের রামসাগর দিঘীপাড়া গ্রামে তার বাড়িতে। ‘দাদু’ বলে জো’রে জো’রে ডাক দিতেই মাটির ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় চৌকিতে বসতে বসতে বাড়ির লোকজনকে ডাক দেন। আমাদের বসার জন্য চেয়ার এনে দিতে বলেন। এ সময় তিনি বারবার পবিত্র ম’দিনা শহরের কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি হ’জে যাওয়ার সময় পাড়ি দেয়া দেশগুলোর নাম বলতে থাকেন। তবে বয়সের ভা’রে অনেক কিছু গু’লিয়ে ফেলছিলেন। এখন লা’ঠিতে ভর করে কোনোমতে চলাফেরা করতে পারেন এই হাজি।

 

 

 

আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বড় ছে’লের স্ত্রী’ (বউমা) সাবিয়া খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, আমা’র শ্বশুর কানে শুনতে পান না। তাই মানুষ কোনো কিছু বললে কী’ বলছে বুঝতে পারেন না। আপন মনে কথা বলতে থাকেন। যতি একটা কানের মেশিনের ব্যবস্থা হতো তাহলে মানুষের কথা ঠিকমতো শুনতে পেতেন। সঠিক উত্তর দিতে পারতেন।