উৎপাদন বাড়িয়ে চাহিদার বড় অংশই মেটানো সম্ভব

বাংলাদেশ

দেশে ভোজ্যতেলের মোট চাহিদার ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। মাত্র ১০ শতাংশ চাহিদা মেটানো হয় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ভোজ্যতেলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদার বড় অংশই মেটানো সম্ভব। সে ক্ষেত্রে সরিষা চাষের পরিধি বাড়ানোতেই গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি সূর্যমুখীসহ অন্যান্য তেলজাতীয় ফসল আবাদ বাড়াতেও কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে জমির সঙ্কট রয়েছে। দেশে প্রধান ফসল ধান বাদ দিয়ে অন্য ফসলে গেলে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে, তাই বোরো ও রোপা আমন ধানের মৌসুমের মাঝখানে সরিষা চাষ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া দেশের লবণাক্ত অঞ্চলে সয়াবিনের চাষ বাড়ানোও সম্ভব। পরিকল্পিতভাবে ফসল বিন্যাস নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাজ করতে হবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, শেষ এক বছরে বাংলাদেশের প্রধান রিফাইনাররা প্রায় ২২ লাখ টন সয়াবিন ও পামওয়েল (ক্রুড) আমদানি করেছে। এর সাথে আমদানি করা প্রায় ২০ লাখ টন সয়াবিন বীজ ভাঙিয়ে চার লাখ টন তেল সংগ্রহ করা হয়। এই সময়ে দেশে প্রায় এক লাখ টন সরিষার তেল উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া অন্যান্য ২০ হাজার টন তেল আমদানি হয়। দেশে মূলত বাসা বাড়ির রান্নায় সয়াবিনের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। ভোজ্যতেলের বেশির ভাগই যেহেতু আমদানি নির্ভর, তাই বিভিন্ন সময়ে বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। এবার ঈদুল ফিতরের আগে থেকেই ভোজ্যতেলের বাজারে সঙ্কট দেখা দেয়। গত বৃহস্পতিবার লিটারে ৩৮-৪০ টাকা (খোলা ও বোতল) বাড়িয়ে দিয়েও বাজারে সয়াবিন তেল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। খোলা সয়াবিনের দাম উঠেছে ২১০ টাকা। এ অবস্থায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলসহ বিশেষজ্ঞরা অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদের ২৭৮ কোটি টাকার প্রকল্প চলমান। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরিষা, তিল, সূর্যমুখী, চীনাবাদাম, সয়াবিনসহ তেল ফসলের আবাদ এলাকা ২০ শতাংশ বাড়ানো ও তেলজাতীয় ফসলের হেক্টরপ্রতি ফলন ১৫-২০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এই প্রকল্পের পরিচালক মো: জসিম উদ্দিন বলেন, তেলজাতীয় ফসলের মধ্যে আমাদের দেশে প্রধান ফসল হলো সরিষা। আমাদের দেশে মূলত প্রধান ফসল ধান। ধান বাদ দিয়ে কৃষক তো সরিষাতে যাবে না। আমরা যেটা চাচ্ছি সেটা হলোÑ স্বল্প জীবনকালের রোপা আমন ধান চাষাবাদের পর কৃষক যাতে স্বল্প জীবনকালের সরিষার আবাদ করেন। সরিষা তুলে তারা বোরো ধান রোপণ করতে পারবেন।

তিনি বলেন, আমরা যদি আমন ও বোরো ধানের মাঝখানে সরিষাকে ঢুকাতে পারি, তাহলে সরিষার আবাদ এলাকা বাড়বে, উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হবে। আমরা সেটাই করছি। আরেকটা যেটা হলো সূর্যমুখী চাষ। এটার জন্য আমরা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কোস্টাল এরিয়াতে, যেখানে লবণাক্ততার কারণে বোরো আবাদ করতে পারে না। এসব জায়গায় সূর্যমুখী চাষ বাড়ানো সম্ভব। এই কৃষিবিদ বলেন, হয়তো দানা ফসলের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব হবে না, কিন্তু আমাদের যে বিশাল আমদানি নির্ভরতা, এই যে বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে, এটা কিছুটা দূর করতে পারব। এ জন্য আমরা সরিষাসহ ভোজ্যতেল চাষাবাদ বাড়াতে কাজ করছি। সয়াবিন চাষ পরিধি বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে প্রায় ৭৫ হাজার হেক্টরে সয়াবিন চাষ হয়। প্রতি হেক্টরে দুই থেকে আড়াই টন সয়াবিন হয়। দেশে যা চাষ হয় তা থেকে তেল বের হয় না। এটা মূলত ফিস ফিড, পোলট্র্রি ফিডে ব্যবহৃত হয়। এর বাইরে বিস্কুট, সয়া কেক, সয়া বিস্কুটসহ কিছু বেকারি আইটেমে এটা ব্যবহৃত হয়। সয়াবিন চাষের পরিধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে অন্তরায় হলোÑ এটা সব জায়গায় চাষ হয় না। একটু লবণাক্ত এলাকা যেমন ভোলা, সুবর্ণচরে ব্যাপক চাষ হচ্ছে। লক্ষ্মীপুরে হচ্ছে। যেসব জায়গায় সুযোগ আছে, আমরা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এ ছাড়া সয়াবিনের মার্কেট লিঙ্কেজে সমস্যা ছিল।

এটা মোটামুটি দূর হয়ে গেছে। যেমনÑ ভুট্টা তো প্রথম বিক্রি করতে পারত না কৃষক। এখন তো ব্যাপক চাহিদা। এখন সয়াবিন বিক্রিতেও সমস্যা নেই। ৫০-৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা যাচ্ছে। যদি বিপুল পরিমাণ জমিতে চাষ করতে পারি, তাহলে হয়তো মেশিন (ভাঙানো) এসে যাবে। কিন্তু এখন নেই কারণ আমাদের প্রডাকশন তো লক্ষ লক্ষ টন নাই।

বাংলাদেশে সয়াবিন ক্রুড অয়েল হিসেবে আসে, আর গ্রুপ অ্যাডিবল যারা তারা কিছুটা বানাচ্ছে সয়াবিন। যেটা (সয়াবিন দানা) কোম্পানিগুলো বাইরে থেকে আমদানি করে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো: আসাদুল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে মাত্র ৮ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষাসহ তেলজাতীয় ফসল হয়। কিন্তু আমাদের সুযোগ আছে আবাদ বাড়ানো। আমাদের যেটা করতে হবে, রোপা আমনে স্বল্পকালীন জাতের ধান চাষ করতে হবে। কার্তিক মাসের মধ্যে ধান কেটে ফেলার কাজ সেরে ফেলতে হবে। ওই মাসেই সরিষা বপন নিশ্চিত করতে হবে। সরিষা তুলে ওই জমিতে বোরো আবাদও করা যাবে, এতে কোনো সমস্যা হবে না। কৃষক একই জমিতে দুইবার ধানও চাষ করতে পারবে আবার মাঝখানে সরিষা চাষ করে লাভবান হবে। এতে কৃষক যেমন লাভবান হবে, তেমনি দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদাও মিটবে। তিনি বলেন, আমাদের মোট আবাদি জমি ৮৫ লাখ হেক্টর। এই জমির মধ্যেই আমাদের সব করতে হবে। একটা ফসল বেশি করলে আরেকটা কমে যাবে, আরেকটা বেশি করলে আরেকটা কমবে। তেলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব না, তবে অনেকটা কাছাকাছি যাওয়া যাবে, যদি পরিকল্পনা মোতাবেক চাষাবাদ করতে পারি।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: বেনজীর আহমেদকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইচ্ছে করলেই সব ধরনের ভোজ্যতেল চাষাবাদ বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে সরিষাটা বাড়ানো যাবে। সয়াবিনের আবাদ বাড়ানো প্রসঙ্গে এই কৃষিবিদ বলেন, বাংলাদেশে তেলের জন্য সয়াবিন আবাদ ওইভাবে সম্ভব না। কারণ ৫ কেজি সয়াবিন বীজ ভাঙিয়ে এক কেজি তেল হয়। আর চার কেজি খৈল বা সয়া কেক হয়। খৈলটা হচ্ছে আসল আর তেলটা হচ্ছে বাই প্রডাক্ট, বিদেশে যেটা করে। তারা তেলের জন্য করে না। খৈল থেকে সয়া বিস্কুট, সয়ামিল অনেক কিছু করে। যাতে প্রচুর প্রোটিন আছে। শুধু তেলে পোষাবে না। আমাদের এখানে শুধু খৈলটা মৎস্য বা প্রাণিখাদ্যে ব্যবহৃত হয়। অন্য দেশের মতো আমাদের এখানেও সয়া কেকের ব্যবহার বাড়াতে হবে। পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে নারকেল চাষের পরিধিও বাড়ানোর ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

বাংলাদেশের সাপ্লাই চেইন নিয়ে কাজ করেন (সলিডারিডার্ড নেটওয়ার্ক এশিয়া) মো: মুজিবুল হক। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালের পর থেকে সয়াবিনের ভালো জাত উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করা হয় না। বারি সয়াবিন ৪ এবং সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সয়াবিনের ভ্যারাইটিজ রিলিজ করেছে। কিন্তু মাঠে এটা ইমপ্লিমেনটেশন করতে পারেনি। সেটা আমরা নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুরে নিয়ে গেছি। পারফরম্যান্স ভালো। এখন দেশে সয়াবিন যে উৎপাদন হয়, মূলত ফিডমিলে ব্যবহৃত হচ্ছে। যদি তেল করতে চাই, তাহলে আবাদ এরিয়া বাড়াতে হবে। এটা বাড়ানো সহজ। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চল, জামালপুর-শেরপুর অঞ্চলসহ অনেক এলাকায় চাষাবাদ সম্ভব। ফসল বিন্যাসটা সেভাবেই পরিকল্পিতভাবে করতে হবে। আমন এবং বোরো ধানের মাঝমাঝি সময়ে চাষ ছড়িয়ে দিতে হবে। সয়াবিন এমন একটা ফসল যেটা রবি ও খরিপ দুই মওসুমেও হয়। বর্ষাকালেও সয়াবিন চাষ সম্ভব।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে ভোজ্যতেল আবাদের পরিধি বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু এত দিন কেন যে খুব একটা মনে করি নাই বুঝতে পারছি না। সয়াবিন এত দিন সস্তায় পাচ্ছিলেন তো, সে কারণেও হতে পারে। আর সরিষার জাতও ভালো ছিল না। ইদানীং বারি সরিষা-১৪ ভালো জাত। আবার বারি-১৮ জাতও আছে।