জেলি, তেল, গ্লুকোজ ব্লেন্ডারে মিশিয়ে কৃত্রিম দুধ তৈরি

দেশ জুড়ে

সাতক্ষীরার তালার হাজরাকাটিতে ড্রামভর্তি পানি, তাতে ঢালা হচ্ছে শাল (ভেজাল) দুধ (বাঁয়ে) ও আটারই গ্রামে জেলি, তেল, গ্লুকোজ ব্লেন্ডারে মিশিয়ে ভেজাল দুধ তৈরির দৃশ্য। ছবি : কালের কণ্ঠ

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার দুগ্ধপল্লী খ্যাত জেয়ালা গ্রাম। এই গ্রামে দুই মাস ঘুরে চার ব্যবসায়ীর বাড়িতে গোপনে ভেজাল দুধ তৈরির দৃশ্য দেখেছেন এ প্রতিবেদক। জেলি, সোডা, সয়াবিন তেল, লবণ, চিনি, স্যালাইন, গ্লুকোজ ও নিম্নমানের গুঁড়া দুধের মিশ্রণে তৈরি হয় কৃত্রিম দুধ।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দুধের জন্য এই উপজেলা বিখ্যাত।

এখানে বিভিন্ন কম্পানির দুধ বিক্রয়ের প্রায় ১২টি (মূলত সংগ্রহ) কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে জেয়ালা গ্রামেই রয়েছে পাঁচটি। এই গ্রামে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১১৫ জন খামারি রয়েছেন। সাতজন বড় এবং ১২ জন মাঝারি ব্যাপারী রয়েছেন। এঁরাই খামারিদের কাছ থেকে দুধ বিক্রয়কেন্দ্রে সরবরাহ করেন। এ ছাড়া ২০ জন ফড়িয়া রয়েছেন, যাঁরা কৃষকদের গরুর দুধ সংগ্রহ করে ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করেন।
কয়েকজন খামারি অভিযোগ করেন, দুগ্ধপল্লীকে পুঁজি করে প্রত্যন্ত এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে নকল দুধের কারবার। এই ভেজালের কারবার করেন মাঝারি ব্যাপারীরা।

তাঁদের দেওয়া তথ্য ধরে ঘোষপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গবাদি পশু পালনের সঙ্গে জড়িত। মূলত খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহকারী বা ব্যবসায়ীদের সরাসরি সম্পৃক্তায় গড়ে উঠেছে কৃত্রিম দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। পরিচয় গোপন রেখে এ প্রতিবেদক ঘুরে ঘুরে দেখেন নকল দুধ উৎপাদনের প্রক্রিয়া।

প্রথমে একটি ব্লেন্ডারে হাফ কেজি খাঁটি দুধ ঢালা হয়। তার সঙ্গে পরিমাণমতো জেলি, ডিটারজেন্ট পাউডার অথবা সোডা, হাফ কেজি সয়াবিন তেল, পরিমাণমতো চিনি, স্যালাইন, লবণ, গুঁড়া দুধ ও গ্লুকোজ দিয়ে ১৫ মিনিট মেশানো হয়। একই উপায়ে মেশানো হয় অন্তত তিনবার। এরপর এটা দেখতে অনেকটা শাল দুধের মতো হয়। সব দুধ একটি পাতিলে ঢেলে তার সঙ্গে এক মণ সাদা পানি মিশিয়ে প্রস্তুত করা হয় খাঁটি দুধের আদলে ভেজাল দুধ।

খামারিরা জানান, এভাবে এক মণ দুধ তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ২৫০ টাকা। আর তা কেন্দ্রে বিক্রি করা হয় এক হাজার ৬০০ টাকা। দুধে প্রস্তুত করা ফ্যাটের উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে দাম, যা উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রায় সাতগুণ বেশি। এভাবে একজন উৎপাদক দিনে দুই মণ ভেজাল দুধ তৈরি করেন। ওই উৎপাদক খামারিদের কাছ থেকে আরো ছয় মণ খাঁটি দুধ সংগ্রহ করে সব মিলিয়ে আট মণ দুধ সরবরাহ করেন কেন্দ্রে। মূলত অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিক্রয়কেন্দ্রের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে গড়ে তোলা হয়েছে এই চক্র।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, খামার থেকে তাঁরা প্রতি লিটার দুধ ৪০ টাকায় কিনে আবার ৪০ টাকায় বিক্রি করেন। ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁদের কিছু কারসাজি করতে হয়। তবে এই ব্যবসার একটি অংশ চলে যায় বিক্রয়কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। মূলত বিক্রয়কেন্দ্রের কর্মচারীরা দুধের ঘনত্ব (ননির ফ্যাট) মেপে টাকা দেন। আর নকল দুধের পরিমিত রাসায়নিক সংমিশ্রণের ওপর নির্ভর করে ঘনত্ব।

সাতক্ষীরা জেলা মিল্ক ভিটার সভাপতি প্রশান্ত ঘোষ বলেন, ‘আগে কেউ কেউ ভেজাল দুধের কারবারে জড়িত থাকলেও এখন সেটি নেই। ’

তালা উপজেলা ভারপ্রাপ্ত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাছুম বিল্লাহ জানান, অনেক খামারির কাছ থেকে ভেজাল দুধ তৈরির তথ্য পেয়েছেন। অসাধু চক্রকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হবে।

তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস জানান, মাঝেমধ্যেই তারা অভিযান চালান। গত ২৭ মার্চ ৪ বস্তা গ্লুকোজসহ বিকাশ ঘোষকে আটক করে ভ্রাম্যমান আদলতে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিপ্তরের সাতক্ষীরার উপপরিচালক মো. নাজমুল হাসান জানান, ভেজাল দুধের খবর জানতে পেরে প্রত্যেকটি বিক্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করা হয়েছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানান হয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মো. মোকলেছুর রহমান বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। এ সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুধ কেনার জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রকে বলেছি। আমাদের মনিটরিং অব্যাহত রয়েছে। ’