প্রকৃতিতে হেমন্তের রূপ

প্রকৃতিতে হেমন্তের রূপ

দেশ জুড়ে পরিবেশ বাংলাদেশ

শরতের শুভ্রতা শেষে হেমন্ত বাংলার জীবনকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে। হেমন্তের স্নিগ্ধ, মায়াময় প্রকৃতির মধ্যে মানুষ যেন তার জীবনকেই খুঁজে ফেরে। এই ঋতুতে মানুষের আসে প্রেম। ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও অভিলাষ এক ভিন্নমাত্রা পায়। হেমন্ত বাংলার মানুষের মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলে ভাব, প্রকৃতিপ্রেম, বাঙালিয়ানা আর নিরন্তর সৃজনশীল কর্মকাণ্ড। শিশির ভেজা দূর্বা ঘাস মাড়িয়ে প্রকৃতির মধ্যে হেমন্তের প্রবেশ সৃজনশীল মানুষের মন ও হৃদয়কে নানাভাবে চাঙ্গা করে, উজ্জীবিত করে।

 

 

শরৎ ঋতুর পায়ে পায়ে/ হেমন্ত যে আসে
শিশির ভেজা সোনা রোদে/ দূর্বা কমল হাসে।
হেমন্ত ঋতুতে প্রকৃতি ও মানুষের রূপবদল খুবই অপূর্ব। দিগন্তবিস্তৃত মাঠজুড়ে কেবল সোনালি ধান আর ধান। সোনালি ধানের ক্ষেত ডিঙিয়ে পূর্ব দিগন্ত রাঙিয়ে উঠছে ভোরের সূর্য। হালকা শীত শীত ভোরের ভেতর মিষ্টি রোদের ওম, অন্যরকম আনন্দ দেয় মনে। হেমন্তের শেষের দিকে গ্রামে আরেকটি দৃশ্য চোখে পড়ে। গাছিরা কুয়াশা ভেঙে ধীরলয়ে হাঁটে, তরতর করে খেজুর গাছে ওঠে, ধারালো দা দিয়ে খেজুর গাছের মাথা চেঁছে রস নামানোর আয়োজন করে।

 

হেমন্তের আসল রূপের বর্ণনা মেলে প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনানন্দের কবিতায়। প্রকৃতি রং বদলায় তার নিজস্ব নিয়মেই। প্রকৃতির পরতে পরতে কত বিচিত্র রং যে মিশে আছে! চোখ খুলে দেখলে মনের গহিনে তা উপলব্ধি করলে প্রাণ যায় জুড়িয়ে। বারবার প্রকৃতি তাই বিশ্ব চরাচরে এক রহস্যের নাম। বিশেষ করে বাংলা ঋতুর বহু বিচিত্র রূপ-রস-গন্ধ মানুষকে মুগ্ধ করে। বিস্মিত করে। এক অভাবনীয় রূপ সৌন্দর্যে বাংলার ঋতু-প্রকৃতি প্রতিটি বাঙালিকে ভাবালুতায় নিমজ্জিত করে। অনাদিকাল থেকে চলে আসছে এ প্রক্রিয়া।হেমন্ত এলে অনেকেই মাছ ধরতে নেমে পড়ে বিলে-ডোবায়। নানারকম দেশি মাছে বাজার তেঁতে ওঠে। আইড়, বোয়াল, চিতল, পুঁটি, ট্যাংরা-কত রকমের মাছ যে ধরা পড়ে। হাওর-বাঁওড়-বিলে তাই হেমন্তে রচিত হয় দলে দলে ধান কাটার পাশাপাশি মাছ ধরাও। মাছ ধরা শেষে ডুলাভর্তি মাছ নিয়ে বীরবেশে ঘরে ফেরে মানুষ। কিষাণির রান্নাঘর থেকে তাজা মাছ ভাজার ম-ম গন্ধ চারদিকে জানান দেয়,

 

 

‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসেজীবনানন্দ দাশের কণ্ঠে শুনতে পাই-
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে- এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে এক দিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।
শিশিরস্নাত সকাল, কাঁচাসোনা রোদমাখা স্নিগ্ধসৌম্য দুপুর, পাখির কলকাকলি ভরা ভেজা সন্ধ্যা আর মেঘমুক্ত আকাশে জ্যোৎস্না ডুবানো আলোকিত রাত হেমন্তকে যেন আরও রহস্যময় করে তোলে সবার চোখে; প্রকৃতিতে এনে দেয় ভিন্নমাত্রা। নবান্ন মানেই চারদিকে পাকা ধানের ম-ম গন্ধ, নতুন অন্ন, গ্রামের মাঠে মাঠে চলে ধান কাটার ধুম, হেমন্তে এই ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। গৃহস্থবাড়িতে নতুন ধানে তৈরি পিঠাপুলির সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বিশ্বকবি ও জাতীয় কবির চোখে হেমন্ত ধরা দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে। কবিগুরু লেখেন, হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে,/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।/ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,/জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’ কাজী নজরুলের কবিতায় ধরা পড়েছে হেমন্তের প্রকৃতির রূপ।

 

ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়া এলো কি ধরণীর সওগাত?/নবীন ধানের অঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ।/’বিন্নি পলাশ’ চালের ফিরনি/তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি/হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত।/শিরনি রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত।আজ ধান পেকে মাঠের পর মাঠ যেন সোনালি-হলুদ রঙে সেজে উঠেছে। হেমন্তের প্রকৃতি সকালের সোনারঙা রোদ বাড়িয়ে দেয় বাংলার পথঘাট আর মাঠের উজ্জ্বলতা, গ্রামের মাঠে যতদূর চোখ যায় সোনালি ধান। লাউয়ের মাচায় যৌবনবতী তরুণীর মতো লিকলিকে প্রতিটি ডগার খিলখিল হাসি, হাওর-বিলে অতিথি পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ।দেশের অন্যতম কবি সুফিয়া কামাল

‘হেমন্ত’ কবিতায় লিখেছেন-
সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে কোন পাথারেরওপার থেকে আনল ডেকে হেমন্তকে?
হেমন্তের অপার সৌন্দর্য। মানুষের মনকে নানা রঙে রাঙিয়ে তোলে এই সৌন্দর্য প্রেমিক হৃদয়কে মাতোয়ারা করে দিয়ে তার মনোলোকে তৈরি করে আশ্চর্য এক জগৎ, যেখানে জীবন ও মানুষই হয়ে ওঠে মূল শক্তি।