পানিতে ডুবে পানির জন্য হাহাকার

দেশ জুড়ে পরিবেশ বরিশাল বাংলাদেশ

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে গত দুই দিন ৫ থেকে ৬ ফুট পানিতে তলিয়ে আছে ভোলার চরফ্যাসনের সাগরকূলের ইউনিয়ন চর কুকরীমুকরির চরপাতিলা গ্রাম। ঢেউয়ের আঘাতে গৃহহীণ হয়েছে চরের শতাধিক পরিবার, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত আরও তিনশ। পানির জন্য ঘর থেকে বের হতে পারছে না চরবাসী। জোয়ারের সময় পুরো চরে এক টুকরা মাটিও শুকনো পাওয়া যায়নি।

 

তারপরও এই এলাকায় পানির জন্য হাহাকার লেগেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ঝড়ে বিধস্ত ঘরভিটা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার গলাপানি ভেঙে খাবার পানি সংগ্রহ করতে দেখা যায় ৬০ বছরের বৃদ্ধা রোসনা বিবিকে। মেঘনার তীব্র স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে এক কলস বিশুদ্ধ পানি নিয়ে নিজ ঘরে ফেরার প্রাণপণ চেষ্টা তার। সেই যুদ্ধে রোসনা বিবির সঙ্গী নাতনি তারা ও মীম।

 

রোসনা বিবি বলেন, ‘গাঙের পানি মাথার ছাউনি, পেডের ভাত বেবাক কাইড়া নিছে। বাকি আছে জানডা (জীবনটা)।

এইডা বাঁচানের লাইগ্যা এই যুদ্ধ। চারদিকে পানি থৈ থৈ করে। পারা দেওনের ( পা রাখার) মাডি (মাটি) পাইনা পানির লাইগ্যা, কিন্তু হেই পানি মুহে দিতে পারি না নুনের লাইগ্যা। পেডে গেলে কলেরা শুরু হয়। ভাত না খাইয়া ২/১ দিন থাওন (থাকা) যায়। কিন্তু পানি না খাওয়া তো থাওন যায় না।’

 

চর কুকরীমুকরি ইউনিয়নের দক্ষিণ চর পাতিলা গ্রামের হাসেম হাওলাদারের স্ত্রী রোসনা বিবি। তিনি জানান, মঙ্গলবার রাতের জোয়ারে মালামালসহ ঘরটি মেঘনায় ভেসে গেছে। এরপর স্বামী-স্ত্রীর ঠিকানা হয় ছেলে নিজাম হাওলাদারের ঘরে। বুধবার নিজামের ঘরের ভিটিসহ একাংশ জোয়ারে ভেসে গেছে। ভিটাবিহীন ঘরে মাচা করে থাকছেন তারা সবাই। প্রতিদিন দুইবারে ১২ ঘণ্টা পানিতে তলিয়ে থাকে পুরো এলাকা।

 

নিজাম ছাড়াও রোসনা বিবির আরও ৫ ছেলে বারেক হাওলাদার, বাদশা, বশির, কাদের ও কাজল একই এলাকায় বসবসাস করেন। সবার ঘরের মাটি জোয়ারে ভেসে গেছে। ঘর পানিতে তলিয়ে আছে তিন দিন ধরে। খাল, বিল সব নোনা পানিতে তলিয়ে থাকায় খাবার পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে।

 


রোসনা বিবি আরও জানান, চেয়ারম্যানের দেওয়া বিস্কুট ও চিড়া খেয়ে সকাল কাটিয়েছেন। রাতে কী হবে জানা নাই তার। সব তলিয়ে থাকায় কোথাও যেতেও পারছেন না। কিভাবে নতুন করে ঘর তুলবেন জানা নেই তাদের।

শুধু রোসনা বিবি নয়, চর পাতিলার প্রায় ৫ হাজার মানুষ জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে। বর্তমানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব কেটে গেলেও দুর্ভোগ কমার পরিবর্তে আরও বেড়েছে।

 

স্থানীয়রা জানায়, চর কুকরীমুকরির চেয়ে পাশ্ববর্তী ঢালচরের অবস্থা আরও খারাপ। এই দুই ইউনিয়নে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ২ শতাধিক ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়নি এমন পরিবার নেই চর পাতিলা আর ঢালচরে। গৃহহারা অনেকের আশ্রয় হয়েছে স্থানীয় বাজার ও অন্যের বাড়িতে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বুধবার ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে তছনছ হওয়া অনেক ঘর কোনোভাবে দাঁড়িয়ে আছে। স্রোতে ভিটার মাটির সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়েছে আসবাবপত্র। মাটিছাড়া ভিটা ও বেড়া ছাড়া খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা ঘরগুলো এখন বসবাসের অনুপযোগী। বসতঘরে মাচা করে দিন কাটাচ্ছে চরবাসী। নোনা পানিতে সব তলিয়ে থাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বুধবার ইয়াস তছনছ করে রেখে যাওয়া এসব ঘরবাড়ি বৃহস্পতিবার দুপুরে আবারও ৬ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। এভাবে গত ২ দিন জোয়ারে ভাসছে পাতিলা ও ঢালচরের ১০ হাজার মানুষ।

 

চরপাতিলার চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা সাগর কূলের ঢালচরের। বাজারের ৬০টি মাছের আড়ত আর শতাধিক বসতঘর বিধস্ত হয়েছে। দুর্গম এই ২ চরে ক্ষতি হয়নি এমন কোন পরিবার নেই। শুকনো জায়গার অভাবে গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পরেছেন চরবাসী। মাথার উপরের ছাউনিহারা দুর্গতদের ভোগান্তির শেষ নাই। স্থানীয় চেয়ারম্যান কিছু শুকনো খাবার বিতরণ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

 

দুপুরে পূর্বপাতিলা বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শিশু সন্তানদের নিয়ে ২০ থেকে ২৫ জন গৃহীনী খালের পাড়ে বসে আছেন। তারা জানান, গত ২ দিন ওই এলাকার খালেক মাঝির ঘরসহ ৩টি ঘর জোয়ারে ভেসে গেছে। জাহাঙ্গীর, আলাউদ্দিন, অম্বিয়া, নেছার, কাদের, হেজু মাঝির টিনের ঘর বিধ্বস্ত অবস্থায় পরে আছে। এসব ঘর থেকে কোন মালামালই সরানো সম্ভব হয়নি। তাই ওইসব ঘরের বাসিন্দারা নিরুপায় হয়ে বাজারে আশ্রয় নিয়েছেন।

 

কুকরীমুকরি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাসেন মহাজান জানিয়েছেন, পুরো কুকরীমুকরিতে চার শতাধিক পরিবার চরম সংকটে পরেছে। তিনি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দুর্গতদের কিছু সহায়তা করেছেন। আর উপজেলা প্রশাসন বিকালে দেড়শ পরিবারকে শুকনো খাবার দিয়েছে। দুর্গত মানুষদের পূর্ণবাসনে বড় সহায়তা দরকার। তা না হলে এসব মানুষের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না। এছাড়া প্লাবন থেকে রক্ষায় চরপাতিলার চারপাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। জোয়ারে শুধু ঘরবাড়ি না, বিভিন্ন ঘেরের ২ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে যা দরিদ্র কৃষকদের জন্য বড় সমস্যা হবে।
ঢালচরের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার জানিয়েছেন, তার ইউনিয়নের ক্ষতি হয়নি এমন কোন পরিবার নেই।

 

জোয়ারের জন্য ক্ষয়ক্ষতির তালিকাও করা যাচ্ছে না। প্রাথমিকভাবে ৬০টি মাছের আড়ত ও শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পেয়েছেন। ঢালচর, কুকরীমুকরির মতোই জেলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার মধ্যবর্তী চরাঞ্চলেও অনেক ঘরের ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।

 

চরফ্যাসন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন জানান, চরপাতিলায় বৃহস্পতিবার বিকালে দেড়শ পরিবারকে শুকনো খাবার দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন শেষ হলে তাদের ত্রাণের পাশাপাশি গৃহনির্মাণ সামগ্রী দেয়া হবে।