বৈচিত্র্যময় বামন গাছ বনসাই

বাংলাদেশ রকমারী

আদতে বামন গাছ। ছোট চেহারায় লুকিয়ে দশাসই গাছ। দেখলে বোঝা যাবে না বয়স কত। পুষ্প প্রদর্শনীতে প্রকৃতিপ্রেমী থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানী সবারই মন নিমেষে জয় করতে জুড়ি মেলা ভার এই বনসাই গাছের।

 

 

বনসাই কি? আজকাল বনসাই শব্দটা অনেকের কাছেই পরিচিত। সহজ ভাষায় বনসাই কথার অর্থ ট্রেতে পোঁতা গাছ। একটা বড় গাছকে বামন করে রাখার কৌশলের নাম বনসাই। জাপানি শব্দ পোনজাই, বানজাই বা বনজাই থেকে ধীরে ধীরে প্রচলন হয় বনসাই। যার বাংলা অর্থ ‘জীবন্ত ভাস্কর্য’।

 

 

অগভীর, ছোট পাত্রে বড় গাছের ছোট আকৃতি বা রূপ প্রদান করা, বড় গাছকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট আকার প্রদান করা বা ছোট করার নাম বনসাই। বনসাইকে জাপানে উদ্ভূত শিল্প বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু বনসাইয়ের প্রচলন হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে চীন দেশে। অবাক করা ব্যাপার হলো, ছোট এই বামনাকারের গাছ তৈরির পেছনেও বেশ জমজমাট একটা ইতিহাস।

 

 

বনসাইয়ের ইতিহাস বনসাই নিয়ে অনেক চমকপ্রদ কিছু আদিম বিশ্বাস রয়েছে চীনাদের মধ্যে। বহুকাল আগে চীনের আকাশসমান উঁচু পাহাড়গুলোতে ছোট ছোট কিছু গাছের জন্ম হতো। আকারে ছোট হলেও সেগুলোর চেহারা বড় বড় গাছের মতোই। এসব গাছ সংগ্রহ করা প্রায় অসাধ্য বিধায় এই গাছগুলো ছিল অত্যন্ত মূল্যবান।

তখনকার চীনের ‘তাও’ ধর্মাবলম্বীরা মনে করতেন, যদি মানুষের হাত দিয়ে বৃহদাকার গাছের অতিক্ষুদ্র প্রতিরূপ তৈরি করা যায়, তাতে এর মধ্যে একধরনের অতিপ্রাকৃতিক ঐশ্বরিক শক্তি এসে জমা হয়। তাতে জগত সংসারে শান্তি ও কল্যাণ হয়। চৈনিক সাম্রাজ্যের সময়ে চীনারা ছোট ছোট পাত্রে খর্বাকৃতির গাছ চাষের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।

 

 

চীনাদের থেকে দ্বাদশ শতকে জাপানিরা বনসাই তৈরির কায়দা রপ্ত করে। প্রাচীন পুঁথির অলঙ্করণে হদিস মেলে, এক জাপানি ভদ্রলোক প্রথম বনসাইয়ের প্রচলন করেন জাপানে। নাম কাসুকা। পরবর্তীতে জাপানি জৈন বৌদ্ধগোষ্ঠী একে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যায়। চীনাদের থেকে বনসাইয়ের পদ্ধতি জেনে জাপানিরা এই শিল্পকে নিয়ে যায় দক্ষতা ও নৈপুণ্যের তুঙ্গে।

বনসাই লম্বায় এক ইঞ্চির থেকেও ছোট হতে পারে। আর খুব বেশি বড় হলে তিন থেকে চার ফুট। সাধারণত বনসাইয়ের উচ্চতা ঘোরাফেরা করে বারো থেকে ছাব্বিশ ইঞ্চির মধ্যে। এক ইঞ্চির কম লম্বা বনসাইয়ের পোশাকি নাম শিনতো। অর্থাৎ, প্রাচীন। মজার ব্যাপার এইটুকু লম্বা গাছের বয়স হয়তো চারশো বছর।

 

 

পশ্চিমা দেশে বনসাই বনসাই শিল্প আজ আর শুধু চীন-জাপানের মতো প্রাচ্যদেশের একচেটিয়া দখলে নেই। ছড়িয়ে পড়েছে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশেও। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড কলেজ পার্কের প্ল্যান্ট মিউজিয়ামে গেলে দেখা যায় দেশি-বিদেশি নানান গাছের সম্ভারের বেশিরভাগই দখল করে রেখেছে এই বামন গাছ।

 

 

টব আর ট্রেতে সাজানো বনসাইয়ের জন্য রয়েছে গোটা একটা গ্যালারি। পাঁচ থেকে বাইশ ইঞ্চি লম্বা গাছগুলোর বয়স সাড়ে তিন’শ থেকে পাঁচ’শ বছর। উদ্যানবিদ্যার রকমারি কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে বাড়তে দেয়া হয় না এসব বড় বড় গাছগুলোকে। প্রয়োজনমতো বা দেখতে সুন্দর করার জন্য গাছের আকৃতি বাড়ানো কমানো হয়।

 

 

বনসাইয়ের বিচিত্র নাম বনসাইয়ের গুঁড়ি বা কাণ্ডও বৈচিত্রময়। রকমারি বনসাইয়ের রকমারি নাম। কোনোটা চোক্কান আবার কোনোটা কেঙ্গাই। কোনোটা হাংকাং। ঝরনার পানির মতন নিচে নেমে যাওয়ার ঢঙে ঝালরগুচ্ছের মত বনসাই- কেঙ্গান।

 

ম্যাপল, আপেল, পাইন প্রভৃতি গাছে এ ধরনের বনসাই করা হয়। হয়ও ভালো। সোজা কাণ্ড যে সব বনসাইয়ের সেগুলোই চোক্কান। লার্চ, পাইন, ক্রিপ্টোমেরিয়া, ফার প্রভৃতি গাছে এ ধরনের বনসাই করা হয়। কাণ্ডে অনেক গ্রন্থিযুক্ত বনসাইকে বলা

 

হয় হাংকাং জাতের। এলম, ট্রাইডন্ট জিলকোং প্রভৃতি গাছ ভালো হয় এ রকম বনসাইয়ে। আর বার্চ, ওক প্রভৃতি গাছ ভালো হয় ঝাড়ুর মতো বনসাইয়ে।

 

 

বনসাই তৈরির আগে বনসাই করার উদ্দেশ্য পরিবেশকে সবুজ রাখা। কাজেই বেছে নেয়া হয় চিরসবুজের চারা। পাহাড়ি অঞ্চল কিংবা গভীর জঙ্গল থেকে বহু কষ্টে ও অনেক খরচ করে

 

 

গাছ জোগাড় করতে হয়। এরচেয়ে অনেক সহজ কলমের চারা বা বীজ থেকে বনসাই তৈরি। গাছ লাগালেই শুধু হবে না। তাকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে ছেঁটে ফেলতে হবে বাড়তি পাতা, কুড়ি।

 

 

তামার বা অ্যালুমিনিয়ামের তার দিয়ে বেঁধে দিতে হবে একটা ডালের সঙ্গে অন্য ডাল। এর ফলে গাছ যেমন ইচ্ছেমতো দ্রুত বেড়ে উঠতে পারবে না তেমনি গাছকে পছন্দমত সরু বা মোটা করা যাবে। এই বাঁধার পদ্ধতি দিয়েই গাছ দিয়ে হরেক রকম ভাস্কর্য তৈরি করেন নামী বনসাই শিল্পীরা।

 

 

কোন গাছ বনসাই হয়? বনসাই তৈরির জন্য গাছ বাছাই করা রীতিমত ঝামেলার কাজ। শুকনো আর কম আলো-বাতাসে বাঁচাতে পারে এমন গাছই বনসাইয়ের জন্য বাছতে হয়। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বলেন, তাল গাছ ছাড়া যে কোনো বড় গাছ যেমন অশত্থ, বট, জাপানি বট, শিমুল, জামরুল, পারুল, তেঁতুল, চন্দন,

গাব, সবেদা, কুষ্ণচূড়া, চাঁপা, মলতাস, দীপি বাহার, থেসপেসিয়া, দেবদারু, বকুল প্রভৃতি নানান গাছের বনসাই তৈরি করা হয়। তৈরি করা হয় দেদার ফুল, ফল ও শাক-সবজির গাছও।

 

 

আজকাল কমলালেবু, পেয়ারা, নারিকেল, বেলিফুল, জুঁইফুলের বনসাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে দিব্যি ঢুকে পড়েছে বেগুন, টমেটো, শিম বা শাল-গমের বনসাই। এছাড়া ছোট জাতের বেদানা, লেবু এমনকী আঙ্গুরেরও বনসাই দেখা যায়।

কিভাবে তৈরি করবেন বনসাই?

উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে, বনসাই তৈরির সময় প্রথম পর্যায়ে একটা বড় টবেই গাছ লাগানো ভালো। আর মাটি? পুকুরের পুরনো কাদা শুকিয়ে ভালো করে গুঁড়ো করে নিয়ে চালুনি দিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। পাতা পঁচা সার ও বালি এই গুঁড়ো কাদার সঙ্গে মিলিয়ে মাটি তৈরি করে নিলে ভালো হয়।

তবে গাছ পোঁতার আগে পানি বেরোনোর ফুটোর ওপর ছোট ডাল বিছিয়ে তার ওপর ঝামা অথবা ছোট- ছোট ইঁটের টুকরো ছড়িয়ে দেয়া দরকার। এর ওপর মাটি দিয়ে গাছ বসাতে হবে। বাড়তি শিকড় ছেঁটে ফেলতে হয়। বনসাই-এর গোড়ার দিকে পানি ও ছায়া দুটোই দরকার।

 

 

পানি দিতে হয় কিভাবে? একটা বড় গামলায় পানি রেখে তার ওপর টবগুলোকে ডুবিয়ে রাখতে হবে। তলার ফুটো দিয়ে পানি আস্তে-আস্তে ঢুকে মাটিকে ভিজিয়ে দেবে। এর ফলে গাছ পাবে তার প্রয়োজনীয় পানি ও পানিতে দ্রবীভূত খনিজ লবণ। ওপর থেকে পানি না ঢালাই ভাল। ঢাললে টবের মাটি সরে যেতে পারে।

শুধু গাছের পরিচর্যা করলেই তো হবে না। যত্ন নিতে হবে টবেরও। এক্ষেত্রে ঝকঝকে চীনা মাটি বা পোড়ামাটির চৌকা অথবা গোল সিরামিক টব বা লম্বা ট্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। বনসাই তৈরির জন্য অনলাইন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা যায়। এছাড়াও আজকাল ইউটিউবে বিনামূল্যের অনেক ভিডিও পাওয়া যায়। যা দেখে দেখে যে কেউ ঘরে বসে বনসাই তৈরি করতে পারেন।

 

 

বনসাইয়ের যত্তন-আত্তি সাধারণ চারাগাছে যে কোন ধরনের যত্ন আত্তি করলেই চলে। বনসাইয়ের ক্ষেত্রে তা করতে হয় কয়েকগুণ বেশি। বর্ষার আগে বা শীত বিদায় নিলেই ডাল ও শিকড় কেটে দেয়া প্রয়োজন। শিকড় কাটতে হয় খুব সতর্কভাবে। গাছকে মাটিসহ বের করে ছুরি বা ব্লেড দিয়ে পাশের দিকে তিন ভাগের একভাগ শিকড় কেটে দিতে হয়। তলার দিকের দু একটা শিকড়ও প্রয়োজনমত কেটে দেয়া যেতে পারে।

 

 

এরপর গাছকে ফের পুরনো টবে বা নতুন টবে লাগানো হয়। এরপর পানি দিয়ে কিছুদিন ছায়ায় রাখা দরকার। কিছুদিন বাদে-বাদে গাছের মূল বা কাণ্ড ছেঁটে দেয়ার উদ্দেশ্যেই গাছকে একটা নিজস্ব চেহারা দেয়া হয়। তবে মূল ঠিকমত ঘন না হলে না কাটাই ভালো। বনসাইয়ের খাবার? জি হ্যাঁ, ছোটদের খায়া নিয়ে নানান বায়না থাকলেও বনসাই এ ব্যাপারে খুবই শান্ত।

 

 

প্রয়োজন মতো গাছকে খাদ্য দিতে হবে। বনসাইয়ের খাদ্য হলো কালো মাটি, বালি, ইটের চূর্ণ, সরষে বা নিমের খোল। বছরে দু’বার ভাঙ্গানো হাড়ের গুঁড়ো আর নিম বা বাদামের খোল সমান-সমান মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারলে খুব ভালো হয়।

ছোট টবের বনসাইয়ের খাবার তৈরি হয় গোবরের পাতলা সার থেকে। প্রতিদিন একবার করে পানি দিতে হয়। গরমকালে সকাল-বিকাল দু’বেলা নিয়মিত পানি দেয়া জরুরি। অকারণে গাছ ছোঁয়ার কোনো দরকার নেই। এতে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়।

বনসাইয়ের সৌন্দর্য বনসাইয়ের নতুন পাতা আসতে শুরু করে গাছ লাগানোর ক’দিন পরেই। ডালপালাও গঁজাতে থাকে। তখন অপ্রয়োজনীয় ডাল ও পাতা ছেঁটে ফেলতে হয়। গুঁড়ি আর ডালপালাকে কৌশলে বাঁকাতে হয়। মোদ্দাকথা এমনভাবে, যাতে দেখলে মনে হয় বয়সের ভারে গাছটা বেঁকে গেছে।

 

 

এখানেই বনসাইয়ের সৌন্দর্য। তবে খুব সাবধান। অনেকেই গুড়ি আর ডালপালা বাঁকাতে গিয়ে ভেঙে ফেলেন। তামা বা অ্যালুমিনিয়ামের তার জড়িয়ে বাঁকানো কাজটা অল্প-অল্প করে বেশ কয়েকদিন ধরে করা ভালো।

প্রকৃতির আশ্চর্য নিয়মে ডালপালাগুলোর বাঁকা অবস্থায় থাকা গা-সওয়া হয়ে গেলে তারগুলো খুলে নিলেই হয়। আর তখনই ফুটে ওঠে বনসাইয়ের সত্যিকারের সৌন্দর্য। বাড়ি-ঘরের আঙিনা, বেলকনি ও ছাদে লাগানো বনসাইতে ফুল বা ফল হলে তার আনন্দ ও সৌন্দর্য অনেকটাই বেড়ে যায়।

 

 

বনসাই বিতর্ক অনেক উদ্ভিদবিজ্ঞানী প্রশ্ন তোলেন, ‘একটা গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে বিনোদন কেন?। এটা এক ধরনের নিষ্ঠুরতা।’ পাল্টা যুক্তি দেন অন্য বিজ্ঞানীরা- ‘বনসাইয়ের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ায় কোন হস্তক্ষেপ করা হয় না।

যা করা হয় তা নিছক বিনোদন নয়, উদ্ভিদ জগতে এক নতুন বৈচিত্র্য সন্ধানের লক্ষ্যেই করা হয়।’ যুক্তি পাল্টা যুক্তির পরও বনসাই তৈরির প্রক্রিয়া থেমে নেই। প্রতি বছরই বৃক্ষমেলা, পুষ্প প্রদর্শনীতে অনেক বৃক্ষপ্রেমী, ফুলপ্রেমী আসেন স্রেফ বনসাইয়ের আকর্ষণে।

 

 

শেষ কথা শহুরে জীবনে সবুজের জন্য হাহাকার। যেদিকে চোখ যায় কেবল ইট, কাঠ আর পাথরের ছবি। করোনায় অক্সিজেনের আকালে নিশ্বাস নেয়া ভার। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উষ্ণতা। তাই ঘরের ভিতর সবুজের সমারোহ করতে পারলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায় বৈকি!

বিশাল বড় বড় আকৃতির গাছকে ছোট আকারে পরিণত করে সেটাকে টবে সাজিয়ে রাখা একটা শখ বা শিল্প, এ ব্যাপারটা আর উদ্ভট নয়। বনসাই শিল্পে আগ্রহী অনেক মানুষ বাংলাদেশে রয়েছেন।

 

 

যারা নিজেরা বনসাই তৈরি করে বাসায় সাজিয়ে রাখেন। অনেকেই দোকান থেকে মনোরম বনসাই কিনে বারান্দায়, ঘরের কোণায় শোভা বর্ধন করেন। ডিজিটাল যুগে বনসাই এর খোঁজে বাগানে বাগানে যেতে হয় না।

আজকাল ফেসবুক অনলাইনে ঘরে বসে বনসাই কেনা যায় অনলাইনে। করোনার লকডাউনে ঘরে বসে সময় কাটাতে, ঘরে অক্সিজেন ও সবুজের সমারোহ বাড়াতে কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে বনসাই তৈরি করা।

ইট-পাথরের এই শহরে বনসাই করে পরিবেশ দূষণ রোধ করার পাশাপাশি অর্থ উপার্জন এবং ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে পারলে মন্দ কী!