যেভাবে ঢাকায় ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা হবে।

ঢাকা দেশ জুড়ে বাংলাদেশ বিশেষ প্রতিবেদন

ঢাকা মহানগরের জন্য নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এই ড্যাপে রাজউকের অধীন এলাকায় আবাসিক ভবনের উচ্চতার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ রাখা হয়নি। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার নাগরিক সুবিধা ও সড়কের প্রস্থ অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা যাবে। এতে ঢাকা শহরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। গত ২৩ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপনে নতুন ড্যাপের অনুমোদন দেয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এর ফলে ২০১০ সালে পাস হওয়া পুরোনো ড্যাপ বাতিল হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নতুন ড্যাপ ২০৩৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। যদিও ২০২০ সালে নতুন ড্যাপের একটি খসড়া প্রকাশ করা হয়েছিল।

 

এতে রাজউকের অধীন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আংশিক এবং সাভার পৌরসভা এলাকায় (১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার) ভবন নির্মাণে সর্বোচ্চ আটতলা পর্যন্ত উচ্চতার বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছিল। এছাড়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় বেড়িবাঁধের পশ্চিমাংশে ঢাকা উদ্যান হাউজিংসহ পুরো অঞ্চল বন্যা প্রবাহ এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছিল। ফলে ওই এলাকায় নির্মাণ করা কয়েক হাজার আবাসিক ভবন কাগজে-কলমে অবৈধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতে খসড়া ড্যাপ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। ড্যাপের গেজেট প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। পরে আবাসন ব্যবসায়ীদের যুক্তিসংগত দাবি আমলে নিয়ে নতুন ড্যাপ অনুমোদন দেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। নতুন ড্যাপে মোহাম্মদপুর এলাকায় বেড়িবাঁধের পশ্চিমাংশের পুরো অঞ্চলকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। তবে অনুমোদন না থাকায় ওই এলাকার ভবন মালিকদের জরিমানা দিতে হবে। রাজউকের একটি কমিটি এই জরিমানার হার নির্ধারণ করবে। রাজউক সংশ্লিষ্টরা জানান, এবারের ড্যাপে আধুনিক নগর-পরিকল্পনার বেশকিছু কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্লক ডেভেলপমেন্ট, কমিউনিটিভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও সেবার বিকেন্দ্রীকরণ, মেট্রো স্টেশনভিত্তিক ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি), জনঘনত্ব জোনিং, ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইট (টিডিআর), ওয়ার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা এবং মানসম্পন্ন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিনোদনকেন্দ্র সৃষ্টির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন শহরের মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করবে। এছাড়া পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আঞ্চলিক পার্ক, জলকেন্দ্রিক পার্ক, ইকোপার্ক তৈরি, পথচারীবান্ধব অবকাঠামো তৈরি ও বাইসাইকেল লেনকে উৎসাহিত করা এবং অযান্ত্রিক পরিবহনকে সামগ্রিক পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করা— এসব বিষয় ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া নতুন ড্যাপে ঢাকায় জলপথকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ৫৭৪ কিলোমিটার নৌপথের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রিত মিশ্র ভূমি ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

 

ঢাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পাঁচটি বৃহৎ আঞ্চলিক পার্ক, ৫৫টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, ২৬টি পার্ক (ইকোপার্কসহ) নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে কেরানীগঞ্জে ৪২৫ একর জায়গায় একটি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন পার্কটির নকশা তৈরির কাজ চলছে। জানতে চাইলে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, শহরের বাসযোগ্যতার কথা বিবেচনা করে নতুন ড্যাপে এলাকাভিত্তিক ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আবাসিক ভবনের সর্বোচ্চ উচ্চতা বা তলার বিধানটি রাখা হয়নি। ফলে যেসব এলাকায় প্রশস্ত রাস্তা ও নাগরিক সুবিধা (পার্ক, মাঠ, জলাশয়, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা) বেশি থাকবে, সেসব এলাকায় বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যাবে। তিনি বলেন, নতুন ড্যাপে রাজউকের অধীন এলাকাগুলোকে ছয়টি প্রধান অঞ্চল ও ৭৫টি উপ-অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এতে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ, ব্লকভিত্তিক আবাসন ব্যবস্থা, মেট্রো ও রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল ও নদী বন্দরকেন্দ্রিক ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, ভূমি পুনঃউন্নয়ন, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য কম দামে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সহজ হবে। ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করতে প্রথমে (১৯৯৫-২০১৫) একটি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) নেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালের জুনে ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ হলেও তাতে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। পরে ড্যাপ পর্যালোচনার জন্য সাত মন্ত্রীকে নিয়ে একটি ‘মন্ত্রিসভা কমিটি’ গঠন করে সরকার। তখন ফের ড্যাপ সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে বাস্তবে রূপ পায়নি ওই পরিকল্পনা। পরে ২০১৫ সালের মার্চে আগের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন এবং স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে একটি জনবান্ধব ও বাস্তবসম্মত ড্যাপ (২০১৬-২০৩৫) প্রণয়নের কাজ শুরু করে রাজউক। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর সচিবালয়ে ড্যাপ পর্যালোচনা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ড্যাপ চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। পরে তা অনুমোদন এবং মতামতের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সব শেষ গত ২৩ আগস্ট এই ড্যাপের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ হয়। রাজউকের ওয়েবসাইটে ড্যাপের পরিকল্পনা নিয়ে বলা হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপদ আবাসস্থলের জন্য আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প এলাকা, বিনোদন পার্ক, খেলার মাঠ, লেক, সাংস্কৃতিক বলয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কমিউনিটি সেন্টারসহ সামাজিক চাহিদার জন্য প্রয়োজনীয় স্থানসমূহ চিহ্নিত হচ্ছে এই ড্যাপে। এতে বিভিন্ন এলাকার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ঢাকা শহরের জনসংখ্যার চাপ কমাতে ড্যাপে জনঘনত্ব জোনিং বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

 

এতে এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নির্ধারণ এবং সে মোতাবেক গুরুত্ব পাবে ভূমি ব্যবহার ও প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা সংস্থানের বিষয়টি। ভূমি ব্যবহার: ভূমি ব্যবহারে ড্যাপে উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময়ের (টিডিআর) কৌশল যুক্ত করেছে রাজউক। ড্যাপ সংশ্লিষ্টরা জানান, এটি রাখা হয়েছে মূলত ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি জমি ও জলাভূমি রক্ষার জন্য। ড্যাপে কোনো জমিকে কৃষি বা জলাভূমি হিসেবে চিহ্নিত করলে সেই জমির অন্য কোনো ব্যবহারের সুযোগ নেই। ফলে জমির মালিক জলাভূমি ভরাট করেন বা কৃষি জমিতে ভবন করেন, উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময়ের পদ্ধতিতে কৃষি বা জলাভূমির মালিককে একটি সনদ দেওয়া হবে। ওই সনদ তিনি বিক্রি করতে পারবেন। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই সনদ কিনবে, তারা অন্য জায়গায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাবে। পুরান ঢাকায় ব্লকভিত্তিক পুনঃউন্নয়ন: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অধীন আটটি থানার ১১টি ওয়ার্ড নিয়ে পুরান ঢাকার বিস্তৃতি। কিন্তু এই এলাকার রাস্তাঘাট একটি আদর্শ নগরের মানদণ্ডের চেয়ে অনেক কম। তাই পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা সংরক্ষণ করে পর্যটন এবং বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করা, বুড়িগঙ্গা নদী ঘিরে পুরান ঢাকার জন্য সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি, সংস্কৃতিভিত্তিক শহর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ভূমির পুনঃউন্নয়ন কৌশল অবলম্বন করে এ এলাকায় মৌলিক সুবিধাদির ব্যবস্থা করা, জনমানুষের নিরাপত্তায় রাসায়নিক গুদাম পর্যায়ক্রমে স্থানান্তর এবং পুরাতন জেলখানা এলাকার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তুলে ধরে জনপরিসর গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত গাছপালাযুক্ত পার্ক, খেলার মাঠসহ খোলা জায়গা সৃষ্টি করতে বলা হয়েছে। পুরান ঢাকার উন্নয়নে অবশ্যই ব্লকভিত্তিক পদ্ধতিতে আসতে হবে জানিয়ে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, বিশ্বের অনেক শহরে এমন নজির রয়েছে।

 

 

তবে প্রকল্প এলাকার সীমানা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে ভৌত ও আর্থ-সামাজিক জরিপ, পরিবেশ ও পরিবহনগত প্রভাব এবং সামাজিক প্রভাব সমীক্ষার সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হবে। পাশাপাশি বাড়ির মালিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোসহ সংশ্লিষ্ট সব সরকারি দপ্তর ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে শুরু করা হবে প্রকল্পের কাজ। জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা শহরের পরিবর্তিত নগর বাস্তবতায় ড্যাপ প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। কিছুটা বিলম্বে হলেও ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জন্য ড্যাপ সঠিকভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা হলে নগরায়ন এবং নগর উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সঠিক গতিপথে নিতে পারে। তিনি বলেন, আগে ঢাকা মহানগরীর জন্য প্রণীত কাঠামোগত পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা বা ড্যাপ দলিলগুলো সঠিক ও পূর্ণ বাস্তবায়নের অভাবেই ঢাকা ক্রমান্বয়ে বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ড্যাপকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেই অনুমোদনহীন শিল্প-কারখানা কিংবা ভবন নির্মাণ হয়েছে।

 

ভূমি ব্যবহার নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে জলাধার-বন্যা প্রবাহ অঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। ফলে ঢাকার বাসযোগ্যতা কমেছে মারাত্মকভাবে এবং ঢাকা ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখন ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।