তারাবীহ নামাজের নিয়ম

ধর্ম
  1. তারাবীহর অর্থঃ
    তারাবীহ অর্থ হচ্ছে ক্ষণিক বিশ্রাম। রমযান মাসে ইশার নামাযের পর তারাবীহ নামাযের প্রতি চার রাকআতের পরে আল্লাহর রাসূল (সঃ) কিছু সময় বিশ্রাম নিতেন। তাই ফকীহগণ এ নামাযের নামকরণ করেছেন তারাবীহ অর্থাৎ ক্ষণিক বিশ্রাম ।
    হাদীসে সালাতুত তারাবীহ বলে কোন শব্দ নেই। বরং হাদীসে বলা হয়েছে, মান কামা রামাদানা ঈমানান ওয়া ইহতিসাবান গুফিরা লাহু মা তাক্বাদ্দামা মিন জামবিহি । অর্থাৎ যে ব্যক্তি রমযান মাসে ঈমান ও ইখলাসের সাথে কিয়াম করবে, তার পূর্বকৃত সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। এর বিখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত নব্বী (রহঃ) মুসলিম শরীফের শরায় লিখেছেন, কিয়াম শব্দটি দ্বারা মূলত সালাতুত তারাবীহকে বুঝানো হয়েছে। কেননা তারাবীহ নামায রমযানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

 

তারাবীহ নামাযের ফযীলত
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, হযরত রাসূলে করীম (সঃ) রমযান মাসের নামায কায়েম করার জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে খুব তাগিদ করতেন না বরং এরূপ বলতেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাসের সাথে রমযান মাসে কিয়াম করবে (অর্থাৎ তারাবীহ নামায আদায় করবে) তার পূর্ববর্তী (সগীরা) গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যাবে।
অপর হাদীসে মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেছেন, মহান আল্লাহ পাক তোমাদের উপর রমযান মাসে দিনের বেলায় রোযা ফরয করেছেন এবং রাতের বেলায় (তারাবীহ) নামায সুন্নত করেছেন। অতএব, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাসের সাথে এ মাসে দিনের বেলায় রোযা রাখবে এবং রাতে কিয়াম করবে (অর্থাৎ তারাবীহ নামায আদায় করবে) তার পূর্বকৃত সমস্ত (সগীরা) নাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে ।

 

তারাবীহ নামাযের জামাআত
নবী করীম (সঃ) নিয়মিত তারাবীহ নামায জামাআতের সাথে আদায় করতেন না। তিনি কয়েকদিন জামাআতের সাথে তারাবীহ নামায আদায় করেছিলেন, এ ছাড়া ঘরে তিনি একাকীও তা আদায় করতেন ।
মহানবী (সঃ) রমযান মাসের কয়েক রাতে বের হন এবং লোকদেরকে সাথে নিয়ে তারাবীহ নামায আদায় করেন। (বুখারী ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিয়মিত তারাবীহ নামায জামাআতের সাথে আদায় না করার কারণ ব্যক্ত করে বলেছেন, আমি নামাযের প্রতি এবং তা আমার সাথে জামাআতের সাথে আদায় করার প্রতি তোমাদের প্রচন্ড আগ্রহ লক্ষ্য করেছি, তবুও অন্যান্য রাতের মত আমি বের হই নি ।

আমার আশংকা হয় যে, তা তোমাদের প্রতি ফরয করে দেয়া হবে, আর ফরয করে দেয়া হলে তোমরা তা যথাযথভাবে আদায় করতে পারবে না। (মিশকাত)
পরবর্তীতে মহানবী (সঃ)-এর ওফাতের পর হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর খেলাফতের সময় এবং হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর খিলাফতের প্রথম দিকে লোকেরা রমযান মাসের রাতে একাকী এবং মসজিদে সমবেত হয়ে জামআতের সাথে তারাবীহ নামায আদায় করতেন । অতঃপর হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) তাঁদের জন্য একজনকে ইমাম নির্ধারিত করে সকলকে এক জামাআতের সাথে তারাবীহ নামায আদায় করার ব্যবস্থা করে দিলেন। সে হতে সকলে এক জামাআতের সাথে বিশ রাকআত তারাবীহ নামায আদায় করতেন। এ ঘটনা ছিল সকল সাহাবীর উপস্থিতিতে। কেউই এতে অসম্মতি প্রকাশ করেন নি। পরবর্তী যুগের তাবিয়ীগণ, তাবে-তাবিয়ীগণ, মুজতাহিদ ও ইমামগণসহ সকলেই তারাবীহ নামাযের এই পদ্ধতি মেনে নিয়েছেন এবং তদনুযায়ী আমল করেছেন যেহেতু উম্মতের উপর ফরয হবার আশংকা আর নেই, তাই খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) তারাবীহ নামায জামাআতের সাথে আদায় করার ব্যবস্থা করে দেন। সুতরাং এটা মহানবী (সঃ)-এর সুন্নতের পরিপন্থী নয় ।
ইমামে আজম হযরত আবু হানিফা (রহঃ) এবং ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) প্রমুখ ইমামদের নিকট তারাবীহ নামায ঘরে একাকী আদায় করা জায়েয আছে। তবে জামাআতের সাথে আদায় করা উত্তম। হানাফী মতে তারাবীহ নামায জামাআতের সাথে আদায় করা সুন্নতে মুআক্কাদাহ।

ইমাম আবূ ইউসুফ (রহঃ) তাঁর উস্তাদ ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ)-কে তারাবীহ নামায এবং এ সম্পর্কে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) কর্তৃক প্রবর্তিত ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বললেন, তারাবীহ নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) তারাবীহ নামায সম্পর্কে নিজের মনগড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি এবং তিনি বেদআতীও ছিলেন না অর্থাৎ দ্বীনের ব্যাপারে তিনি নতুন কোন কিছু আবিস্কার করেন নি । তিনি মূল দলীলের ভিত্তিতে এবং মহানবী (সঃ)-এর নিকট হতে শিক্ষার প্রেক্ষিতেই তারাবীহ নামাযের জন্য এই জামাআতের ব্যবস্থা করেছিলেন ।

তারাবীহ নামাযের রাকআতের সংখ্যা
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর মতে তারাবীহ নামায ২০ রাকআত । ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)-ও ইহা গ্রহণ করেছেন ।

হযরত জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, মহানবী (সঃ) তাঁদেরকে সাথে নিয়ে তারাবীহ নামায ৮ রাকআত আদায় করেছিলেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, মহানবী (সঃ) তারাবীহ নামায ২০ রাকআত আদায় করেছিলেন। অবশ্য কোন কোন মুহাদ্দিস এ হাদীসকে সনদগত দিক দিয়ে যয়ীফ বলেছেন; কিন্তু এর মর্ম সহীহ । কেননা ইমাম বায়হাকী (রহঃ)-এর এক সহীহ বর্ণনায় আছে, হযরত ওমর ফারুক (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ)-এর যুগে তারাবীহ নামায ২০ রাকআত আদায় করা হতো।
মহানবী (সঃ) যদি তারাবীহ নামায ২০ রাকআত না-ই আদায় করতেন তাহলে তাঁরা ২০ রাকআত আদায় করতে কোন অবস্থাতেই সাহস করতেন না এবং অপর সাহাবীরাও অবশ্যই এর প্রতিবাদ করতেন । সুতরাং বুঝা যায়, মহানবী (সঃ) প্রথম দিকে তারাবীহ নামায ৮ রাকআত আদায় করতেন এবং শেষের দিকে ২০ রাকআত আদায় করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) শেষ অবস্থাটিই গ্রহণ করেছেন।

সুতরাং তারাবীহ নামায ২০ রাকআত হওয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এবং সর্বযুগের মুসলিম উম্মাহ ও মুজতাহিদ ইমামগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন।

তারাবীহ নামাযের ওয়াক্ত
তারাবীহ নামাযের সময় ইশার নামাযের পর হতে সুবহে সাদিকের পূ পর্যন্ত থাকে। বিতের নামাযের পূর্বে ও পরে তারাবীহ নামায আদায় করা যায়। তবে বিতেরের পূর্বে আদায় করাই উত্তম।

তারাবীহ নামাযের নিয়ত نويت أن أصَلَّى اللَّهِ تَعَالَى رَكْعَتَى صَلوةِ التَّرَارِيح سُنَّة ثال الله تعالى مُتَوَجَها إلى جهَةِ الكَعْبَةِ الشَّرِيفَةِ الله أكبر .
উচ্চারণঃ নাওয়াইতুআন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তাআ’লা রাকাআ’তাই সালাতিত তারাবীহ সুন্নাতু রাসূলিল্লাহি তা’আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিলাি কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।
বাংলা নিয়ত ঃ আমি কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তারাবীহর দুই রাকমাত সুন্নাত নামাযের নিয়াত করছি। আল্লাহু আকবার।

তারাবীহ নামায আদায় করার নিয়ম
ইশার নামায আদায় করার পর অর্থাৎ ইশার চার রাকআত ফরয, তারপর দু’রাকআত সুন্নত নামায আদায় করার পর তারাবীহ নামায দু’রাকআত করে আদায় করতে হয়। এভাবে মোট বিশ রাকআত নামায় আদায় হবে। । একাকী দু’রাকআত সুন্নত নামায আদায় করার যে নিয়ম রয়েছে, তারাবীহ নামাযও একই নিয়মে আদায় করতে হয়। শুধু কারণবশতঃ তারাবীহ নামাযের নিয়াত করতে হবে। একাকী নামায আদায় করার ক্ষেত্রে দু’রাকআতের নিয়ত করার পর প্রতি রাকআতে সূরা ফাতিহাসহ অন্য একটি করে সূরা পাঠ করতে হবে । আর জামাআতে নামায আদায় করার ক্ষেত্রে ইমাম সাহেবের পিছনে কোন সূরা কিরাত পাঠ করতে হবে না। মনোযোগের সাথে ইমাম সাহেবের কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণ করতে হবে। দু’রাকআত শেষ করে যাে আত্তাহিয়্যাতু, দরুদ শরীফ এবং দোয়া মাসূরা পাঠ করে দু’দিকে সালম ফিরারে পুনরায় দু’রাকআতের নিয়ত করতে হবে। চার রাকআত নামার আদায় করা হলে কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিবে। বিশ্রাম নেয়া মুস্তাহাব। নেয়ার সময় উপরোক্ত দোয়া বা অন্য যে কোন দোয়া বা তাসবীহ প যায়। তবে এ দোয়া পাঠ করতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা চুপচাপ বসে থাকলেও কোন গুনাহ বা নামাযের কোন ক্ষতি হবে না।