ফড়িয়ার পেটে ধানের মধু

ফড়িয়ার পেটে ধানের মধু

কৃষি

নিজের এক বিঘা জমিতে ধানচাষে এবার কৃষকের খরচ হয়েছে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। আর যারা বর্গা নিয়ে চাষ করেছেন তাদের অতিরিক্ত আরও ৭ হাজার টাকা ধরলে খরচ দাঁড়ায় ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় প্রতিবছরের চাইতে এবার উত্তরের জেলাগুলোতে বিঘাপ্রতি ধানের ফলন নেমে আসে প্রায় অর্ধেকে। অর্থাৎ আগে যেখানে প্রতিবিঘায় ২০ মণের ওপর ধান মিলতো সেখানে এবার এলাকাভেদে ফলন পাওয়া গেছে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১২ মণ। এই অঞ্চলের হাট বাজারে বর্তমানে ধানের পাইকারি মূল্য ১০০০ থেকে ১২৫০ টাকা। কৃষকের তথ্য অনুসারে এই দামে ধান বিক্রি করে তাদের লাভতো দূরের কথা, উৎপাদন খরচই উঠবে না।

 

অন্যদিকে ধান ঘরে ফেলে রাখার সুযোগও নেই। তাই ফড়িয়া ব্যবসায়িদের কাছে বাজার মূল্যের চাইতে কম দামে সব ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার সাধুবাড়ি গ্রামের কৃষক গোলাম রব্বানী জানান, তিনি ১৫ বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছিলেন। প্রতিবিঘা জমিতে ধানের ফলন হয়েছে গড়ে ১২ মণ হারে। এটা কখনোই আশানুরূপ নয়। গত বছর তিনি একই জমিতে ফলন পেয়েছিলেন ২২ মণ। এবার ফলন কম হওয়ার পরও বাজারে ধানের দাম পড়ে গেছে। কাঙিক্ষত মূল্যে ধান বিক্রি করতে না পেরে লোকসান গুণতে হয়েছে। এই লোকসানের পরিমাণ প্রতি বিঘায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। মামুরশাহি গ্রামের কৃষক হায়দার আলী ও শফিকুল ইসলাম বলেন, মৌসুমের শুরু থেকেই এবার আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না। ভরা বর্ষায় তেমন বৃষ্টিপাত হয়নি।

 

শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে সেচ দিয়ে আমন ধানের চারা লাগাতে হয়। এতে বিঘা প্রতি দুই হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। এছাড়া সব কৃষিপণ্যই বাড়তি দামে কিনতে হয়েছে। শ্রমিক ব্যয়ও দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু মৌসুমের শেষমুহূর্তে এসে অতিবৃষ্টিতে ধানক্ষেত পানিতে ডুবে যায়। যার কারণে জমির সিংহভাগ ধান চিটা হয়ে গেছে। তাদের এলাকায় বিঘা প্রতি ফলন হয়েছে ৯ থেকে ১২ মণ করে। কৃষক আব্দুল কাউয়ুম বলেন, ধান বাজারে বিক্রি করতে গিয়েও বিপাকে পড়তে হয়। ক্রেতা কম থাকায় ফড়িয়া ব্যাপারিরা ৯০০ টাকা মণ দরে (বাজার মূল্যের চাইতেও কম) ধান ক্রয় করেছেন। এতে লোকসান গুণতে হয়েছে। এক বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করতে এবার ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এরমধ্যে বীজতলা, জমি প্রস্তুত, সেচ, শ্রমিক ব্যয়, আগাছা পরিষ্কার ও নিড়ানি, সার ও কীটনাশক ব্যয় রয়েছে।

 

এছাড়া ধান কাটা-মাড়াই বাবদ আরও চার হাজার ব্যয় হয়েছে। কিন্তু এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করে (ফড়িয়াকে না দিয়ে) পাওয়া গেছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। আর ফড়িয়ারা কিনলে এই দাম আরও ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা কম মিলেছে। লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট গ্রামের কৃষক আমিনুল হক বলেন, ২০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করে ফলন পেয়েছি ২৫০ মণ। প্রতিবিঘা হিসাব করলে পরিমাণ দাঁড়ায় ১২.৫ মণ করে। নিজে জমিতে শ্রম দিই। তারপরও প্রতি বিঘা জমিতে ধান চাষে খরচ হয়েছে সাড়ে ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। এক সপ্তাহ আগে হাটে ধানের দাম ছিল ১১৫০ টাকা মণ। আর এখন দাম চলছে ১০৫০ থেকে ১১০০ টাকা। আমার খরচই যেখানে ১১ হাজার টাকা, সেখানে এই দামে ধান বিক্রি করে খাবো কী? নিজের জমি বলে কিছুটা রক্ষা পেলেও যারা বর্গা চাষ করেন তাদের গলার ফাঁস হয়ে গেছে এই ধান।

 

দিনাজপুরের রামনগর এলাকার কৃষক ডাবলু প্রামাণিক বলেন, গত হাটের থেকে এই হাটে ধানের দাম একটু কম। নতুন উঠলে ধানের দাম কিছুটা হলেও বেশি ছিল। এবার বৃষ্টি ছাড়া আবাদ করতে হয়েছে। সার সংকট ছিল। যার কারণে বেশি খরচ হয়েছে। উত্তরের বেশ কয়েকটি জেলার হাট-বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিআর-৪৯ জাতের ধান ১১২০-১২০০ টাকা, বিআর-৫১ জাত ১০০০-১১০০ টাকা, শম্পা কাটারি ১২৫০-১৩৫০ টাকা ও ৯০ জাতের ধান ১১৫০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দামে ধান বিক্রি করে কৃষকরা লোকসান গুনলেও ফড়িয়ারা লাভবান হয়ে ফুলেফেঁপে উঠছেন। তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কমদামে ধান কিনে বড় বড় অটোমিলগুলোতে বেশি দামে বিক্রি করছেন। এছাড়া সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হলেও বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। এমনকি সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে গিয়ে নানামুখি হয়রানির শিকার হওয়ার কারণে ধান বিক্রি করতে না পারায় কোনো সুফল পাচ্ছেন না বলে ভুক্তভোগী কৃষকরা জানিয়েছেন। কৃষকদের অভিযোগ, ধানের বাজার অস্থিতিশীল করে ফড়িয়ারা কৃষকদের জিম্মি করে কমদামে ধান কিনছেন। তারা সিন্ডিকেট করে প্রথমে ধান কেনা বন্ধ করে দেন। এতে ধানের বাজার ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষক। আর এই সুযোগে কম দামে ধান কিনে নেন তারা।
কৃষকের খরচ কত

আমন চাষে এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে ব্যয় সম্পর্কে শেরপুর উপজেলার সাধুবাড়ি গ্রামের কৃষক গোলাম রব্বানী ও মোজাম্মেল হক জানান, জমি প্রস্তুতের জন্য হালচাষ বাবদ তাদের ব্যয় ২০০০ টাকা হলেও এবার বৈরি আবহাওয়ার কারণে জমি প্রস্তুতি থেকে ধান ঘরে তোলা পর্যন্ত সেচ বাবদ অতিরিক্ত ২০০০ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। আমন চাষে কোনো সেচ খরচ করতে হয় না। কিন্তু এবার বর্ষা মৌসুমেও বৃষ্টির দেখা ছিল না। তাই বোরো মৌসুমের মতোই সেচ দিয়ে আমন ধানের চারা রোপণ করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে আমনে প্রতি বিঘা জমিতে বাড়তি ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে কৃষকের। এছাড়া টিএসপি ১০ কেজি ৩০০ টাকা, এমওপি (পটাস) ১০ কেজি ৩০০ টাকা, ইউরিয়া ৫ কেজি ১৫০ টাকা, জিপসাম ১০ কেজি ১৫০ টাকা, দস্তা ১ কেজি ২০০ টাকা, সালফার ৩ কেজি ১২০ টাকা, ম্যাগনেশিয়াম সার ২ কেজি ৮০ টাকা, এরপর জমির আইল কাটা বাবদ শ্রমিক ব্যয় ২০০ টাকা, ধানের চারা রোপণ বাবদ ১২০০ টাকা, আগাছা প্রতিরোধে কিটনাশক ও ইউরিয়া ৫ কেজি বাবদ ১৫০ টাকা, জমি নিড়ানি বাবদ শ্রমিক মজুরি ৫০০ টাকা খরচ হয়েছে।

দ্বিতীয় দফায় আবার ইউরিয়া সার ১০ কেজি ৩০০ টাকা, এমওপি (পটাস) ৫ কেজি ১৫০ টাকা ও ড্যাপ সার ৫ কেজি ১২০ টাকা, কিটনাশক ব্যয় ১৫০০টাকা, ধান কাটা ও মাড়ায় বাবদ ৪০০০ টাকা এবং বীজ ও বীজতলা তৈরি বাবদ ১০০০ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। এছাড়া বর্গাচাষিদের জন্য অতিরিক্ত ৭০০০ টাকা জমি লিজ নেওয়া বাবদ ব্যয় করতে হবে।