যে মৃত্যু ঠেকানো যায়

যে মৃত্যু ঠেকানো যায়

গণমাধ্যম দেশ জুড়ে

মানুষ মাত্রই মরণশীল। তাই জন্ম নিলে মরতেই হবে। আমরা কেউই এর ব্যতিক্রম নয়। অর্থাৎ, মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। আজ নয় তো কাল; একদিন না একদিন প্রত্যেককেই প্রকৃতির অবধারিত নিয়মে মুত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। প্রকৃতি নির্ধারিত এই মৃত্যু আমরা ঠেকাতে পারি না। কিন্তু, কিছু মৃত্যু আছে যা প্রকৃতিবিরুদ্ধ; সেগুলো আমরা চাইলেই ঠেকাতে পারি। আরেকটু দীর্ঘ করতে পারি প্রিয়জনের বেঁচে থাকা। প্রকৃতিবিরুদ্ধ এই মৃত্যুর নাম “আত্মহত্যা”।মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। একটু সচেতন হলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা যায়। ঠেকানো যায়, প্রিয়জনের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু।বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে আত্মহত্যার নীরব মহামারি চলছে। বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর কমপক্ষে ১৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন। আর পুরো বিশ্বে বছরে আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। অর্থাৎ বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করেন।

 

গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে অন্তত প্রতি দশ জনে একজন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা রয়েছে

 

সম্প্রতি দেশে একজন তারকা শিল্পী এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর পর বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। এছাড়া, গত কয়েক মাসে দেশে বেশ কয়েকটি আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।বিশেষ করে কমবয়সীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যাকে ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।এদিকে, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত বাংলাদেশি গবেষকদের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অন্তত প্রতি দশ জনে একজন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা রয়েছে।আত্মহত্যার পেছনে বিভিন্ন ধরনের কারণ থাকলেও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকেই আত্মহত্যার অন্যতম প্রভাবক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোট আত্মহত্যার প্রায় ৯০% ঘটে থাকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাজনিত কারণে।তবে পরিবার, স্বজন, বন্ধু কিংবা আশেপাশের মানুষ একটু সচেতন, একটু যত্নশীল হলেই বেশিরভাগ আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব।মানসিক অসুস্থতার পাশাপাশি, বাংলাদেশে যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল, বুলিং, ইভটিজিং, মাদকাসক্তি, ইন্টারনেট আসক্তি, দারিদ্র্য ও বেকারত্বসহ বিভিন্ন কারণ আত্মহত্যার প্রভাবক হিসেবে দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। একটি হলো- আগে থেকে পরিকল্পনা করে, যেটাকে বলা হয়, “ডিসিসিভ সুইসাইড”। এক্ষেত্রে অনেকেই সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেন। অন্যটি হলো- রাগ, ক্ষোভ কিংবা আবেগের বশবর্তী হয়ে হুট করে আত্মহত্যা করা। যেটাকে বলা হয়, “ইমপালসিভ সুইসাইড”

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আশেপাশের মানুষ একটু সচেতন হলেই ডিসিসিভ সুইসাইডের প্রায় বেশিরভাগই প্রতিরোধ করা সম্ভব।তাদের মতে, ডিসিসিভ সুইসাইড প্রবণতা থাকা ব্যক্তিরা আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের আচরণের মাধ্যমে আত্মহত্যার ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। এসব ইঙ্গিতের মধ্যে রয়েছে


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার প্রকাশ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আত্মহত্যা বা মৃত্যুবিষয়ক গান, কবিতা কিংবা বিভিন্ন পোস্ট
আত্মহত্যা বা মৃত্যুবিষয়ক গান, কবিতা কিংবা বই পড়া বাড়িয়ে দেওয়া
হাত-পা কাটা বা অন্য কোনোভাবে নিজের ক্ষতি করা
নিজেক অপরাধী ভাবা
স্বাভাবিক উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলা
নিজেকে গুটিয়ে ফেলা
এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী বিষণ্ণতাসহ সিজোফ্রেনিয়া পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার এবং মাদকাসক্তির মতো বিভিন্ন মানসিক রোগও ব্যক্তিকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে।

এসব ক্ষেত্রে আশেপাশের মানুষ যদি তাদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মেশার চেষ্টা করেন, তার অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করেন, তার ভেতরে ইতিবাচক ভাবনা সঞ্চার করতে পারেন কিংবা তাকে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে পারেন তাহলে আত্মহত্যাজনিত জীবনের অপচয় অনেকটাই রোধ করা সম্ভব। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবারই জোর দিয়ে বলছেন, প্রিয়জনের সান্নিধ্য আত্মহত্যার ঝুঁকি হ্রাস করে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যক্তি, পরিবার এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। বিশেষ করে গণমাধ্যমে আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ক প্রচারণা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, তারা অন্যের আত্মহত্যার খবরে নিজেরাও প্রভাবিত হতে পারেন। তাই বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।

গণমাধ্যমে আত্মহত্যা সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মেনে চলার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আত্মহত্যা সংক্রান্ত যেকোনো পোস্ট শেয়ারের ক্ষেত্রে প্রত্যেককে সতর্ক থাকতে হবে। আত্মহত্যার ঘটনাকে যুক্তিযুক্ত বা মহৎ করে দেখানো যাবে না, একইভাবে কারো আত্মহত্যার প্রবণতাকে নিয়ে বিদ্রূপও করা যাবে না।

আমাদের সমাজে প্রায়ই দেখা যায়, কেউ মৃত্যুর ইচ্ছা প্রকাশ করলে পরিবারের স্বজনরা সেটিকে তেমন গুরুত্ব দেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিষয়টি নিয়ে বন্ধুরা হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠেন। কিন্তু এটি একদমই ঠিক না। আত্মহত্যার ইচ্ছাপ্রকাশকেই আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় লক্ষণ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত তার প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে হবে। তার সমস্যা শোনার পাশাপাশি ইতিবাচক পরামর্শ দিতে হবে। প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

আত্মহত্যা সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে যা মেনে চলতে হবেআত্মহত্যা সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে যা মেনে চলতে হবে

আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা। এই সচেতনতা থাকতে হবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল সবখানে। যেকোনো স্থানে আত্মহত্যার প্রসঙ্গ উঠলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। বরং বোঝাতে হবে যে, আত্মহত্যা যে কোনো সমাধান নয়। আত্মহত্যার ইচ্ছাপ্রকাশকারীকে নিয়ে কটূক্তি নয়; তাকে সাহস যোগাতে হবে, দিতে হবে অনুপ্রেরণা। উৎসাহিত করতে হবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে।

এক্ষেত্রে মাদকাসক্তি, ইন্টারনেট আসক্তি, রাত জাগার প্রবণতা থেকে নিরৎসাহিত করতে হবে। বিপরীতে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে সন্তান ও শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে।